Image description
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর >> পছন্দের কোম্পানির জন্য রি - টেন্ডার কারসাজি । » অভিযোগের তির মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি , ডিজি , পিডির দিকে । » টিকা কেনায় অনিয়ম খুঁজতে তদন্ত করছে দুদক ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে গরু - মহিষ ও ভেড়া - ছাগলের খুরারোগের ১০০ কোটি টাকার টিকা কেনার দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে । কয়েকটি সূত্রে বলা হয়েছে , এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘ ওএমসি কোম্পানি'কে টিকা কেনার কাজ দিতে মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে সরাসরি তদবির করেছেন । এ কারণে ওই কোম্পানিকে কাজ দিতে দরপত্রে কিছু কারসাজির আশ্রয় নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন , কয়েকজন ব্যক্তির স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ টিকাটি কেনায় অনিয়ম করা হলে তা দেশের গোটা প্রাণিসম্পদ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে । জানা গেছে , অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক ) তদন্ত করছে । কর্মকর্তারা জানিয়েছেন , প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ‘ পিপিআর রোগ নির্মূল এবং খুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনা হচ্ছে । সে দফায় প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৩ সালের ১৪ মে । তখন বরাদ্দ ছিল ১২০ কোটি টাকা । ২০২৩ সালের দরপত্রে অংশ নেয় টেকনো ড্রাগস লিমিটেড , জেনটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস — এই তিন কোম্পানি । সংশ্লিষ্টরা বলছেন , মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে ব্যর্থ হয়ে ওই টেন্ডার বাতিল করে দেন । জুলাই - আগস্টের গণ - অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টিকা কেনার জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট । তবে এবার বরাদ্দ ১০০ কোটির মধ্যে রাখা হয় । এবারের দরপত্রে অংশ নেওয়া সাতটি কোম্পানি হচ্ছে— বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস , গ্লোবাল ইনস্ট্রুমেন্ট সাপ্লাই লিমিটেড , জেনটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ওএমসি লিমিটেড , টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড ও রেনেটা লিমিটেড । এতে সর্বনিম্ন দরদাতা তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো জেনটেক ( ৭৯ কোটি ২৫ লাখ ) , ওএমসি ( ৮২ কোটি ৫০ লাখ ) এবং রেনেটা ( ৯৭ কোটি ১৪ লাখ ) ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন , এক প্রভাবশালী সর্বনিম্ন দরদাতাকে উপেক্ষা করে ওএমসিকে কাজ দিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে তদবির করেন । তাই দরপত্রপ্রক্রিয়া বাতিল করে আবার তা আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর । দ্বিতীয় দফা দরপত্রের সময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ( ডিজি ) ছিলেন মোহাম্মদ রেয়াজুল হক । দরপত্র বাতিলের বিষয়ে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ টিকা সরবরাহের দ্বিতীয় দফায় দরপত্রে ত্রুটি থাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়া হয়নি । আমরা চেয়েছিলাম টিকা যাতে ভালো হয় এবং সরকারের অর্থও যাতে সাশ্রয় হয় । ' সাশ্রয়ের কথাই বিবেচনায় থাকলে তৃতীয়বারের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে ২০ কোটি টাকা বেশি দরে কেন কাজ দেওয়া হয়েছে , এ প্রশ্ন করা হলে সাবেক এই ডিজি বলেন , ‘ শেষবার আমি দায়িত্বে ছিলাম না । তাই ও বিষয়ে কথা বলতে চাই না । '

তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয় , গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর । এতে অংশ নেয় জেনটেক , ওএমসি ও রেনেটা । অভিযোগ , এই দফায় ওএমসি লিমিটেডকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্তে কিছু পরিবর্তন আনা এবং নতুন শর্ত যোগ করা হয়েছে । গত বছরের ২৭ আগস্টের টেন্ডারে শর্ত ছিল , টিকার নমুনা জমা দিতে হবে । টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি বা সাব - টেকনিক্যাল কমিটি তা পরীক্ষা করবে । নমুনা পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত শর্ত ( স্পেসিফিকেশন ) পূরণ হলে টেন্ডার গ্রহণযোগ্য হবে । তবে ২৩ ডিসেম্বরের টেন্ডারে এই শর্ত বদলে দেওয়া হয় । সেখানে বলা হয় , ভাইরাস নিউট্রালাইজেশন টেস্টে ( ভিএনটি ) উত্তীর্ণ হলেই টেন্ডার গ্রহণযোগ্য হবে ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন , স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষা হলে টিকার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় । আর ভিএনটি পরীক্ষায় মেলে টিকা সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য । নতুন টেন্ডারে আরেকটি নতুন শর্ত যুক্ত করা হয় । তা হচ্ছে , উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের টিকা কমপক্ষে ৩ টি এশীয় দেশে রপ্তানি বা ব্যবহৃত হওয়ার প্রামাণ্য দলিল টেন্ডার নথির সঙ্গে জমা দিতে হবে । বিষয়টি ওএমসির সঙ্গে মিলে যায় । এ কোম্পানিকে টিকা সরবরাহ করে আর্জেন্টিনার ‘ বায়োজেনেসিস বাগো ’ নামের প্রতিষ্ঠান । তারা এশিয়ার তিনটির বেশি দেশে এই টিকা সরবরাহ করে । অন্যদিকে সর্বনিম্ন দরদাতা জেনটেক চীনের চায়না অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ইন্ডাস্ট্রি কো . লিমিটেড ( সিএএইচআইসি ) থেকে টিকা সরবরাহের কথা জানিয়েছে ।

তৃতীয়বারের টেন্ডারে জেনটেক খুরারোগের ( এফএমডি ) ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৫ হাজার ৭১৪ ডোজ টিকা সরবরাহে সর্বনিম্ন ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার দর দেয় । দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দর ৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা দেয় ওএমসি এবং রেনেটা ৯৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা দর দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকে । কিন্তু দ্বিতীয় দফার টেন্ডারের চেয়ে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বেশি দর দিয়েও সরবরাহের কাজ পেয়েছে ওএমসি । প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কয়েকটি সূত্র অভিযোগ করেছে , প্রভাবশালী ব্যক্তিটির তদবিরের প্রভাবে ওএমসির পক্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ( ডিজি ) আবু সুফিয়ান । এ প্রতিবেদক বিষয়টি নিয়ে জানতে অধিদপ্তরের ডিজির দপ্তরে গেলে তিনি টিকা বিষয়ে কথা বলতে চান না বলে জানান । অন্যদিকে বেশি দর দেওয়ার পরও সরবরাহের কাজ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওএমসি লিমিটেডের মালিক এম এ মান্নান ভূঁইয়া মোবাইল ফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' ডলারের দাম বাড়ায় আমরা দ্বিতীয়বার দর বাড়িয়ে দিয়েছি ।

বিশেষ একজন ব্যক্তিকে জড়িয়ে অনিয়মের যেসব বিষয় বলা হচ্ছে , সেসব বিষয়ে আমার জানা নেই । ' প্রাণিসম্পদ খাতে টিকা সরবরাহে তার কোম্পানির আগের কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি না , জানতে চাইলে মান্নান ভূঁইয়া আর কথা বলতে চাননি । দরপত্রসংশ্লিষ্টরা বলছেন , শুধু টিকায় নির্দিষ্ট একটি উপাদান থাকার যুক্তি দিয়ে জেনটেককে দরপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে । রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য টিকায় অ্যাডজুভেন্ট নামের উপাদান মেশানো হয় । ওএমসি তাদের টিকার সঙ্গে স্যাপোনিন অ্যাডজুভেন্ট সরবরাহ করার কথা জানিয়েছে । অন্যদিকে জেনটেক বলেছে সেপিক অ্যাডজুভেন্ট সরবরাহ করার কথা । টিকার মান যাচাইয়ে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি বা সাব- টেকনিক্যাল কমিটি করা হলেও বলা হচ্ছে তা মূলত লোক দেখানো ।

অভিযোগ , সব কারসাজি করেছেন প্রকল্প পরিচালক অমর জ্যোতি চাকমা । কারণ , ওই সব কমিটিতে এমন ব্যক্তিদেরও রাখা হয়েছে , যাঁদের টিকা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও নেই । টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটির একজন হলেন মন্ত্রণালয়ের আইটি বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্ট ইলিয়াস হোসেন । টিকার মান যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন । এদিকে ১৫ থেকে ২২ মে পর্যন্ত ‘ বায়োজেনেসিস বাগো ' কোম্পানির কারখানা পরিদর্শন করতে আর্জেন্টিনা ভ্রমণ করেছে পিপিআর রোগ নির্মূল এবং খুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ সাব - টেকনিক্যাল কমিটির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল । এই ভ্রমণের পুরো খরচ বহন করেছে টিকা সরবরাহের কাজ পাওয়া ওএমসি লিমিটেড । অথচ ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ না করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশনা রয়েছে । অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্ৰকল্প দপ্তরে একাধিকবার গিয়েও প্রকল্প পরিচালক অমর জ্যোতি চাকমাকে পাওয়া যায়নি ।

অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তাঁর তিনটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে । টিকা বিশেষজ্ঞরা বলেন , পৃথিবীর অঞ্চলভেদে ভাইরাসের জিনগত বংশ বা স্ট্রেন আলাদা হয়ে থাকে । বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ বা এশিয়া অঞ্চলে বিদ্যমান ভাইরাসের সঙ্গে মিল রেখে টিকা আনা জরুরি । অন্য দূরবর্তী অঞ্চলের টিকা কতটা কার্যকর , তা আগে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে । জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পশুদের টিকা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড . নিতীশ চন্দ্ৰ দেবনাথ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ আমাদের দেশে যে ভাইরাস আছে , তার সঙ্গে মিল রেখে টিকা আনতে হবে । তা না হলে টিকা কাজ করবে না ।' সার্বিক বিষয়ে জানতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারকে একাধিকবার কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি । 

তবে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো . তোফাজ্জেল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' টিকা কেনার টেন্ডারপ্রক্রিয়া নিয়ম মেনে করা হয়েছে । সাব - টেকনিক্যাল কমিটি যে টিকার কার্যকারিতা আছে , সেটাই কেনার জন্য সুপারিশ জানিয়েছে । এসব প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী কারও ভূমিকা আছে কি না , তা আমার জানা নেই । ' টিকা কেনায় সম্ভাব্য অনিয়ম ও দুর্নীতির এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুদকের একটি দল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অভিযান চালিয়েছে । দুদক সূত্র জানিয়েছে , প্রকল্প পরিচালক অনুপস্থিত থাকায় অধিদপ্তরের এক পরিচালকের ( প্রশাসন ) সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে দুদক টিম কথা বলেছে । তারা সংশ্লিষ্ট কিছু নথি সংগ্রহ করেছে । এ বিষয়ে দুদকের তদন্ত কার্যক্রম চলছে ।