Image description
বিধি ভেঙে নিয়োগের সুপারিশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অফিসের প্রধান সহকারী পদের জন্য আবেদন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে পড়ুয়া মো. প্লাবন ইসলাম। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বসেন ব্যবহারিক পরীক্ষায়। ফল প্রকাশ হলে মেধাতালিকায় ১ নম্বর স্থান পান তিনি। কিন্তু বিপত্তি বাধে ভাইভা বোর্ডে। পরীক্ষায় প্রথম হয়েও ভাইভায় বাদ পড়েন তিনি। অন্যদিকে, লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় দশম হওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হন! অভিযোগ উঠেছে, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদের পছন্দের প্রার্থী মো. মোহাম্মেল হোসেনকে নিয়োগ দিতে বিধিমালা ভেঙে ভাইভার নম্বর বাড়ানো হয়েছে।

জানা যায়, গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে প্রধান সহকারী পদে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত ২৪ মে অনুষ্ঠিত লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলে প্লাবন প্রথম ও মো. আসিফ নামে আরেকজন চতুর্থ হন। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী মোহাম্মেল হোসেন মেধাতালিকায় অর্জন করেন দশম স্থান। লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা হয় যথাক্রমে ৩০ ও ২০ নম্বরে। তবে ভাইভায় নম্বর রাখা হয় ৫০। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের প্রার্থী লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় দশম হওয়ায় তার নম্বর বাড়িয়ে নিতে ভাইভায় ৫০ নম্বর রাখেন প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন। শুধু তা-ই নয়, একই দিনে লিখিত, ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষা নিয়েও উঠেছে নানা অভিযোগ। একবার লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পর কোনো নোটিশ না দিয়েই ৪০ মিনিট পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায়ও ছিল না কোনো সিট প্ল্যান। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে পরীক্ষা দেন মোহাম্মেল। প্রথমবার লিখিত পরীক্ষা শেষে মোহাম্মেলকে রুমে ডেকে নেন প্রক্টর। এ সময় প্রায় ২০ মিনিট রুমে একসঙ্গে থাকার পর জানানো হয় আবার লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হবে। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বাকি ২৯ জন অনেকটা অবাক হন। পরে বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় বসেন তারা। এ ছাড়া ভাইভার পর মেধাক্রম প্রকাশ না করেই সিলেকশন কমিটি মোহাম্মেলকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

শুধু প্লাবনই নন, মেধাতালিকায় থাকা এবং পরবর্তী সময়ে ভাইভায় বাদ পড়াদের মধ্যে পাঁচজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী। প্লাবন কালবেলাকে বলেন, ‘আমাকে আন অফিসিয়ালি বলা হয়েছিল লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। কিন্তু প্রথম হওয়ার পরও কেন চূড়ান্ত রেজাল্ট হাতে পেলাম না? ২৭ মে প্রক্টর অফিসে গিয়ে রেজাল্টের কথা বললে সহকারী প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম (সিলেকশন বোর্ডের সদস্য) বলেন, রেজাল্টে তোমাদের নাম নেই। কার নাম আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনে পড়ছে না, পরে বলব। পরে কল দিলে তিনি বলেন, রেজাল্ট নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি সিদ্ধান্ত নাই হয়, তাহলে প্রথমে তিনি কেন বললেন আমার নাম আসেনি?’

প্লাবন ও আসিফের অভিযোগ, ‘মোহাম্মেলের প্রতি পুরো এক্সাম বোর্ড সহায়ক ছিল। সবার কম্পিউটার এক্সাম শেষ হলেও উনি (মোহাম্মেল) এক্সাম কক্ষে ১০ মিনিট বেশি ছিলেন। যদিও আমাদের এক্সাম সময় ৫ মিনিট ছিল। কম্পিউটার এক্সাম শেষ হওয়ার পর ওই রুমে আবারও যান মোহাম্মেল। দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার সময় মোহাম্মেলকে অফিস রুমে ডাকা হয় কেন?’

তারা বলেন, ‘স্যাররা পরীক্ষার দিন বললেন, মেধার ভিত্তিতে পরীক্ষার ফল দেওয়া হয়েছে, তাহলে আজ (সোমবার) কল দিলে তিনি (সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম) বলেন, এটা এমনিতে রোল অনুযায়ী হয়েছে। অথচ আমাদের পরীক্ষায় কোনো রোল ছিল না। মেধার ভিত্তিতে না হলে নোটিশ দিল কেন? আজ (সোমবার) প্রক্টর অফিসে রেজাল্ট দেখতে গিয়ে দেখি নোটিশ বোর্ডে টানানো রেজাল্ট শিট ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।’

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি মেধাতালিকা নয়, এমনিতেই একটি তালিকা করা হয়েছিল। আমরা আসলে নিয়োগের অনেক বিধি জানতাম না, জানা উচিত ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী, চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষায় অসংগতি হলে তার কারণ জানিয়ে আবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া যাবে। ভাইভার নম্বর কখনো লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষার সমান হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে কম হতে পারে। এ ছাড়া লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর ভাইভার পরও আবার মেধাক্রম প্রকাশ করতে হবে। যদিও এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রক্টরের কাছের ব্যক্তি মোহাম্মেলকে নিয়োগ দেয় সিলেকশন বোর্ড।

সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এ বিধিমালাগুলো জানতাম না; কিন্তু রেজিস্ট্রার যেহেতু প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তার তো উচিত ছিল এ বিষয়ে আমাদের জানানো।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী আসিফ কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে তিনশ টাকা ব্যাংক ড্রাফট জমা দিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিলাম। কিন্তু অনিয়ম করে নেওয়া হলো অযোগ্য একজনকে, যে আবার এক কলেজ থেকে পড়ালেখা করে আসছে। ৫ আগস্টের পরও পূর্ব থেকে চলে আসা এ পদ্ধতির পরিবর্তন কি আদৌ হবে না?’

সূত্র জানায়, মোহাম্মেলকে পদের জন্য নিয়োগের সুপারিশ রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে পাঠায় সিলেকশন বোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা উপাচার্যের কাছে এ সুপারিশ ফরোয়ার্ড করার পরে ভিসি অনুমোদন দিলেই নিয়োগ পাবেন মোহাম্মেল হোসেন।

এদিকে দুইবার লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে অবগত নন বলে জানিয়েছেন বোর্ডের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুন্সী শামস উদ্দিন আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু ভাইভা বোর্ডে ছিলাম। এর আগে কী কী হয়েছিল আমি জানি না।’ ভাইভা বোর্ডের অনেকেই নিয়োগ বিধিমালা জানেন না—এ কথা জানিয়ে তিনি কেন বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানাননি, তা জানতে চাইলে শামস উদ্দিন বলেন, ‘এগুলো তো জানা বিষয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী এ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘প্রথমবার পরীক্ষা শেষে আবার দ্বিতীয়বার নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিধিমালা নেই। প্রথমবার পরীক্ষা নেওয়ার পর অভিযোগ আসছে এ প্রশ্ন বাইরে টাইপ করা হয়েছে। যেহেতু এখানে একজন প্রার্থী ছিলেন, এজন্য এটা ঠিক হয়নি, যার কারণে আবার পরীক্ষা নেওয়া হয়।’

ভাইভায় বেশি নম্বর রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। সিলেকশন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়।’

মেধাক্রম প্রকাশ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রার্থীরা যখন ভাইভা দিতে ঢুকেছে, তখন তাদের নম্বর বলা হয়েছে।’ যদিও পরীক্ষার্থীরা বলছেন, ভাইভায় তাদের কোনো নম্বর জানানো হয়নি।

‘কাছের’ প্রার্থী মোহাম্মেল হোসেনকে নিয়োগ দিতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সাইফুদ্দিন বলেন, ‘আমার অফিসে যারা কাজ করে সবাই আমার প্রিয় হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। যারা এখানে কাজ করে, তারা কাছের হওয়া কি অপরাধ?’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানি না। আপনার মুখ থেকেই প্রথম শুনলাম। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব।’