
বিগত আওয়ামী শাসনামলে সারা দেশে পশুর চামড়া নিয়ন্ত্রণে ছিলো শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দরিদ্র লোকজন। গরিবের হক মেরে চামড়ার টাকা লুটপাট করেছেন আওয়ামী লীগ নামধারী নেতাকর্মীরা। শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে পাচার করেছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। সঙ্কটে ফেলেছেন দেশের চামড়া শিল্পকে। কোরবানির চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। বছরের পর বছর চলে এই লুটপাটের খেলা। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চামড়ার দাম নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন কোরবানিদাতা ও ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন, আওয়ামী সিন্ডিকেটের পতনের পর নতুন করে সিন্ডিকেট হলে সঙ্কটে পড়বে চামড়া শিল্প। তাই সঠিক তদারকির মাধ্যমে চামড়ার ব্যবসায়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাজে লাগাতে হবে। কোরবানিদাতারা যেন চামড়ার ন্যায্য দাম পান সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ কোরবানিদাতারা ন্যায্য দাম পেলে গরিব-দুঃখিরা তাদের ন্যায্য হক থেকে অন্য বছরের মতো বঞ্চিত হবেন না।
ইতোমধ্যেই পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে গত বছরের তুলনায় এবার গরুর চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি বাড়ানো হয়েছে পাঁচ টাকা। আর খাসি ও বকরির চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে দুই টাকা করে। গত ২৫ মে সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন চামড়ার নতুন দর ঘোষণা করেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় গুরুর চামড়া প্রতিপিস ১৩৫০ টাকার নিচে কেনা হবে না এবং ঢাকার বাইরের চামড়া ১১৫০ টাকার নিচে কেনা হবে না।
তিনি বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার ক্ষেত্রে তথাকথিত সিন্ডিকেট ভাঙতে দেশের এতিমখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং প্রান্তিক পর্যায়ে ৩০ হাজার টন লবণ সরবরাহ করা হবে। উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টরা যেন চামড়া মজুত রাখতে পারে। এ বছর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে বেশি হবে। এ বছর চামড়ার দাম যতক্ষণ ন্যায্য না হবে, ততক্ষণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। মাদরাসা ও এতিমখানায় ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। একটি নির্দেশনামূলক ভিডিও তৈরি করবো। সেগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হবে। ঈদের পরের দিন এ কমিটি আবার বসবে, দাম ঠিক রাখতে সব সময় কাজ করা হবে। আগে সারা দেশে একসঙ্গে কাঁচা চামড়া আসতো। চামড়া পচে যাবে সে কারণে দাম না পেলেও বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। এবার সেটা হবে না। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা চান গরিবের এই হক যেন ন্যায্যমূল্য পায়।
কোরবানিদাতারা জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনলেও চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র কয়েকশ’ টাকায়। কোনো কোনো সময় চামড়া কেউ নিতে আসে না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পারায় মাটিতে পুতে ফেলেছেন অনেকে। গরিব লোকজন চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মূল্য না পেয়ে। আওয়ামী লীগের ট্যানারি মালিক ও আড়তদার সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানিদাতারা সরকারের বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেকও পাননি। কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে কমে চামড়া কেনার পরও লোকসান গুনেছেন। বিগত সময়ে চামড়া শিল্পকেও ধ্বংস করে গরিব ও অসহায়দের হক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকার লোক দেখানো চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছিলো যা খুবই সামান্য। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কোরবানির চামড়ার ভয়াবহ দরপতন ঘটায়।
তারা আরো বলছেন, এবার আওয়ামী লীগের সেই সিন্ডিকেট নেই। নতুন করে যেন আর কোনো সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দেখতে না হয়। এবছরও কোনো সিন্ডিকেট হলে গরিব-দুঃখীরা তাদের হক বঞ্চিত হবেন। সিন্ডিকেট বন্ধ করে চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জনা যায়, এ বছর ঈদুল আজহায় সর্বমোট কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি। এবার প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোরবানির পশুর অবাধ চলাচল বা পরিবহন নিশ্চিত করা হবে। এ বছর কোরবানিযোগ্য হৃষ্টপুষ্ট গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্য প্রজাতিসহ মোট এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এ বছর প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা পূরণ করার মতো সক্ষমতা রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জনা যায়, আওয়ামী লীগের সময়ে পানির দরে বিক্রি হয়েছে কুরবানির পশুর চামড়া। গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় আসেনি মৌসুমি চামড়া ক্রেতারা। কুরবানিদাতারা হয় চামড়া ফেলে দেন। না হয় বিনামূল্যে এতিমখানাগুলোতে দিয়ে দেন। ঈদুল আজহার দিন কুরবানির পশুর চামড়া কিনতে কেউ আসেনা। ২/১শ’ টাকায় কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ওই চামড়া আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে গেলে তারা অর্ধেক দামে কিনতে চায়। মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করলেও বিক্রি করতে পারেনি তারা। বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই অবশেষে মাটিতে পুতে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। ফলে লোকসান গুণতে হয়েছে।