
রাজধানীর গুলশান এলাকায় গত ২০ মার্চ দিবাগত রাত ৯টার দিকে টেলি সুমন (৩৫) নামে এক যুবককে গুলি চালিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নৃশংস এ হত্যার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার দুই মাস চার দিন পর গত রবিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে পুলিশ প্লাজার খুব কাছেই ঘটে আরেকটি নৃশংস ঘটনা। কিলাররা খুব কাছ থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে খুন করে বিএনপি নেতা কামরুল ইসলাম সাধনকে। এ হত্যার দৃশ্যও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সর্বশেষ গতকাল সকাল ১০টার দিকে মিরপুরে প্রকাশ্যে এক ব্যক্তিকে গুলি করে ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ঘটেই চলছে হত্যা, গুলি, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের দুর্ধর্ষ সদস্যরা। মাঝেমধ্যেই ঘটছে ‘মব’-এর ঘটনা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরোধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা উদ্বেগ ছড়াচ্ছে সমাজে। উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে অপহরণের ঘটনা। গত মার্চেই ৮৩ জন অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে দুজনের বেশি অপহৃত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে কমপক্ষে ৭৮টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন। আহত হয়েছেন ৭২৭ জন। একই মাসে গণপিটুনির ২২টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। আহত হয়েছেন ২১ জন। ১৯৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮ জন। এর মধ্যে ৫২ জন ১৮ বছরের কম বয়সি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ছয়জনকে।
জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলসংলগ্ন এক ব্যবসায়ীর বাসায় এক মাসের মাথায় দুই দফা গুলির ঘটনায় নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগছেন রাজধানীবাসী। গত ১৬ মে দিবাগত রাতে রাজধানীর জিগাতলা ও মোহাম্মদপুরে সামিউর রহমান ওরফে আলভী (২৭) ও নুর ইসলাম (২৪) নামে দুই তরুণ খুন হন। এ দুই ঘটনায় আহত হওয়া চারজন জানিয়েছেন তাদের ওপর হামলাকারীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ এন এস নজরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এখনো মব সৃষ্টির মতো ঘটনাগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। মব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি কলাবাগান থানার ওসিসহ তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিএমপির সব ক্রাইম ডিভিশনের ডিসি এবং থানার ওসিদের বিশেষ বার্তা দেওয়া আছে।
২২ এপ্রিল বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে শ্রীলঙ্কান তিন নাগরিককে অপহরণের ঘটনা ঘটে। এক দিন পর তাদের উদ্ধারসহ জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। ১৪ এপ্রিল নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। একই মাসে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ এনে যুবক-যুবতীকে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের সিলেট্যা বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে নাদিম (৩৫) ও মাসুদ (২৯) নামে দুজন নিহত এবং সোহাগ (২৮) নামে একজন আহত হন।
ধর্ষণের মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ডোমারের গোমনাতী মডেল একাডেমি নামের একটি কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ মিজান আহমেদকে (৪২) বস্ত্রহরণ, মাথার চুল কেটে রং মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে বেধড়ক গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওমরাহ শেষে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসা নোয়াখালীর আবদুল কাদের মিলন নামে এক ব্যক্তিকে (৩৫) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন এক গৃহবধূ।
মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওকে কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা। মহানগর এবং বিভাগীয় শহরগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নইলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পতিত শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ভূমিকা রাখছে। দাবিদাওয়ার নাম করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে সীমাহীন জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তারুজ্জামানসহ (ওসি) তিন কর্মকর্তা প্রত্যাহারের ঘটনার নেপথ্যেও পতিত সরকারের এজেন্টরা কৌশলী ভূমিকা রেখেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় বিশেষ মনিটরিং করা হচ্ছে।
টার্গেটে ছিলেন সাধন : একাধিক সূত্র বলছে, বাড্ডায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে কামরুল ইসলাম সাধন হত্যার ঘটনায় অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে নাম আসছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী হাসান ওরফে কলিন্স গ্রুপের। ৫ আগস্ট-পরবর্তী আন্ডারওয়ার্ল্ডে নয়া মেরূকরণে নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে অবস্থান জানান দিচ্ছেন কলিন্স। ২০১৫ সালে বাড্ডায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামাসহ ফোর মার্ডার দিয়ে আলোচনায় আসা কলিন্স আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হন।