
চলতি মাসের শুরুতে দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় বেড়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর (বিএসএফ) পুশ ইন। কখনো তারা তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মায়ানমারের নাগরিকদের পুশ ইন করছে, আবার কখনো ভারতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের আটক করা নাগরিকদের ঠেলে দিয়েছে। গত ৭ থেকে ২৫ মে ১৮ দিনে ১১ জেলার সীমান্ত দিয়ে ৫২৮ জনকে পুশ ইন করা হয়। এই সময়ে খাগড়াছড়ি, কুড়িগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুমিল্লা ও ফেনী জেলার সীমান্ত দিয়ে সর্বমোট ৪৫০ জনকে পুশ ইন করেছে ভারত।
এ ছাড়া সুন্দরবনের গহিন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে। ভোরের দিকেই বেশি পুশ ইন করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এদিকে এই পুশ ইন নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নজরদারি বাড়ালেও স্থানীয়রা আতঙ্কে রয়েছে। সরেজমিনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, গত ৭ মে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তপথে ভারতে অবস্থান করা ২১ জন রোহিঙ্গা ও ৯ জন বাংলাদেশিকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করেছে বিএসএফ। ৬ মে গভীর রাতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তাদের পুশ ব্যাক করা হয়। পরে তাদের আটক করে বিজিবি ও রৌমারী থানার পুলিশ।
রৌমারী বিজিবি ও সীমান্ত পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণ শালমারা মাইনকারচর জেলার শাহপাড়ার বিএসএফ সদস্যরা মঙ্গলবার গভীর রাতে ২১ জন রোহিঙ্গাসহ ৩০ জনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পুশ ব্যাক করেন। তাদের মধ্যে বিজিবির টহলদল ২৭ জনকে আটক করে। এ ছাড়া রৌমারী থানার পুলিশ উপজেলার কর্তিমারী এলাকা থেকে তিনজনকে আটক করে।
কুড়িগ্রাম বিজিবি ২২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাহবুব উল হক বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা দালালের মাধ্যমে উখিয়া থেকে ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে এসেছে। তাদের উন্নত দেশে পাঠানোর কথা বলে দালালরা এখানে নিয়ে এসেছে। পরে তাদের ফেলে দালালরা পালিয়েছে।
ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা নবিউল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সীমান্তে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। আমরা এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে ভয়ে থাকি, কখন কী হয়।’ তিনি আরো বলেন, আগে সীমান্তে ছিল মাদকের ভয়, এখন রোহিঙ্গার ভয়।
রৌমারীর আরেক বাসিন্দা রবিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো আমাদের এলাকায় আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লোকের আনাগোনা দেখি। জানি না তারা এখানকার বাসিন্দা কি না। তবে আমরা চাই আমাদের নিরাপত্তা।’
গত ১৮ মে উত্তরের আরেক জেলা ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১৭ জনকে পুশ ইন করে বিএসএফ। বিজিবি জানায়, ওই দিন ভোর ৫টার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চাপসার বিওপি এলাকায় সীমান্ত মেইন পিলার ৩৪৮/২এস থেকে প্রায় ২০ গজ ভেতরে বাংলাদেশের রামপুর এলাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে ঘোরাঘুরির সময় ১৭ জনকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে যশোর, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বরিশাল ও নড়াইল জেলার নারী-পুরুষ ও শিশুরা। আটক ব্যক্তিদের বয়স চার থেকে ৬০ বছর।
২১ মে বুধবার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ধবলসূতী গাটিয়ারভিটা সীমান্তে সাতজন নারী ও চার শিশুকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। বর্তমানে ওই ১১ জনকে পাটগ্রাম থানার পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ৬১ বিজিবি। বিষয়টি পাটগ্রাম থানার ওসি মিজানুর রহমান নিশ্চিত করেছেন।
সর্বশেষ ২২ মে বৃহস্পতিবার ভোরে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের বাংলাদেশে পুশ ইনের চেষ্টার সময় চারজনকে আটক করেছে বিজিবি। ৪২ বিজিবি বলছে, ভোরে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরুচুনা সীমান্তে দুজন নারীকে বাংলাদেশে পুশ ইনের সময় আটক করে বিজিবি। একই রাতে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার রামচন্দ্রপুর সীমান্তে আরো দুজন পুরুষকে পুশ ইন চেষ্টার সময় বিজিবি সদস্যরা আটক করেন।
পুশ ইনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুশ ইন না করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। এ ছাড়া পুশ ইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তত্পরতা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে বলে জানায় তারা।
সিলেটের তিন সীমান্ত দিয়ে ১৫৩ জনকে পুশ ইন
সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার তিন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ১৫৩ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। শনিবার গভীর রাত থেকে গতকাল রবিবার ভোরে তাদের পুশ ইন করা হয়। বিয়ানীবাজারের নয়াগ্রাম, বড়লেখার শাহবাজপুর চা-বাগান ও লাতু সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশ ইন করা হয়। এর মধ্যে সিলেটের বিয়ানীবাজারের সীমান্ত দিয়ে ৩২ জনকে এবং মৌলভীবাজারের দুই সীমান্ত দিয়ে বাকি ১২১ জনকে পুশ ইন করা হয়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিজিবি তাদের আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুর দেড়টার দিকে বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা পুলিশের কাছে তাদের হস্তান্তর করে। সবাই বাংলাদেশি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়ন বিয়ানীবাজারের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল মেহেদী হাসান।