Image description

দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে গত বৃহস্পতিবার (২২শে মে) প্রচারিত একটি রাজনৈতিক ভাষ্যে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকেও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল।’ 'প্রফেসর ইউনূস এখন কী করবেন' শিরোনামের এ সংবাদ ভাষ্য 'শান্তনা রহমানের' নামে প্রচারিত হলেও এটি মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর লেখা। এটা সাংবাদিকতায় তার 'ছদ্মনাম'।

মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট সাংবাদিক যখন মবোক্রেসির এ কালে কিছু লেখেন, এর সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েই লেখেন। ড. ইউনূসের সরকার চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের রাখাইনে কথিত 'মানবিক করিডর' দেওয়ার আয়োজন তলে তলে করেছে বলে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ।

বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আয়োজনের যে দাবি জানাচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষ্মণ রাজনীতির মাঠে তেমন নেই। ২১শে মে ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্বাচন বিষয়ে তার অবস্থান আগের মতো রয়েছে বলে জানিয়ে রাখাইনে 'মানবিক করিডর' দেওয়ার বিষয়টি নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।

নির্বাচনের সময় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার জন্য কথিত করিডর দেওয়ার প্রশ্ন ও চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর অসন্তোষ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে, তখন এসব বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এমন অবস্থানের জন্য সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীর দিকে জনমত চলে যায়, সরকার এ ভূমিকার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস সরকারপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দেন। যদিও তার হুমকিকে জনগণের বিরাট অংশ আস্থায় নেয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ঠিক এমন সময়ে ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনাম পত্রিকাটিতে 'অভিমানী' সরকারপ্রধানের ‘মান ভাঙাতে’ কলাম লেখেন ‘প্লিজ ডোন্ট রিজাইন: অ্যাপিল টু প্রফেসর ইউনূস’। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়- ‘দয়া করে পদত্যাগ করবেন না: ড. ইউনূসের প্রতি আবেদন’।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো সরকারপ্রধান, বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে নিয়ে এমন প্রশংসাযুক্ত ‘কলাম’ মাহফুজ আনামের মতো নামকরা ও প্রথম সারির কোনো সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক লিখেছেন বলে জানা যায়নি। এ ‘কলাম’ ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। গত বছরের ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও দেশের সাংবাদিকতায় 'লেজুড়বৃত্তি' নতুন করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে কী না, এ প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেনরা।

ক্ষমতাবানরা যে ফাঁদ পেতেছেন, 'সংস্কারের' দাবিদার সাংবাদিক সমাজের কোনো অংশ তাতে ধরা দিচ্ছেন কী না, এমন প্রশ্নও অনেক নেটিজেনের। অনেকের প্রশ্ন, মাহফুজ আনাম আলোচ্য লেখাটির মাধ্যমে কি বার্তা দিতে চেয়েছেন? তিনি কি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদেশিদের হাতে চট্টগ্রাম বন্দর তুলে দেওয়া, বা রাখাইনে করিডোর দেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিক সমাজের পক্ষে প্রেরণা দিচ্ছেন? লেখাটিতে তিনি ‘আমরা গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে তার (ড. ইউনূস) পাশে থাকব’ ঘোষণা দেন। অনেকে বলছেন, এতে তিনি পেশাগত নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রশ্ন আসছে, তিনি কি এক এগারোর জরুরি অবস্থার তত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ভূমিকার পথে হাঁটছেন?

এক এগারোর সেনা সমর্থিত জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে মাহফুজ আনামের সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা পত্রিকা ডেইলি স্টার অশুভ শক্তির সরবরাহ করা সংবাদ যাচাই-বাছাই না করে ছাপিয়ে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করত বলে অভিযোগ আছে। একপর্যায়ে তিনি বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে স্বীকার করেন, তিনি এক এগারোর সময় গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যে যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদ ছেপে ভুল করেছিলেন।

দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গত শুক্রবার (২৩শে মে) পত্রিকাটিতে প্রকাশিত বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, '২০০৭ সালে একই সুশীল পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা মইনুল হোসেনকে প্রকাশ্যে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ওই সরকারটি তারাই গঠন করেছিলেন।' মাহমুদুর রহমান নিজের লেখায় সুশীল সম্পাদকের নাম উল্লেখ না করলেও তিনি হচ্ছেন মাহফুজ আনাম।

ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ‘আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন ডেইলি স্টারের প্রকাশক মাহফুজ আনাম। গত ১৮ই এপ্রিল ডেইলি স্টারে 'আনহেলদি ইলেকশন কন্ট্রুভার্সি মাস্ট বি রিসলভড' শিরোনামে প্রকাশিত এক কলামে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ দেশের আর কোনো সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কোনো সরকারের পক্ষে কলাম লিখে এভাবে ঘোষণা দেওয়ার নজির নেই।

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতে, সাংবাদিকদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। এ প্রশ্নের মানে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা নয়। এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সত্য তুলে আনাই সাংবাদিকতা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে একশ্রেণির সাংবাদিকের তার প্রতি স্তুতিবাদের কারণে দেশের সাংবাদিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর প্রধান উপদেষ্টাকে সামনাসামনি বসে যেভাবে ‘অভিযুক্ত’ করেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়, সেটা আওয়ামী লীগের শাসনামলে চিন্তা করা যেত না। ছাত্র-জনতার অভ্যত্থান চলাকালে ওই সময়ের সরকারের জারি করা কারফিউ ভাঙার অভিযোগে ড. ইউনূসকে চাঁচাছোলা ভাষায় অভিযুক্ত করেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার নেওয়া সাংবাদিক নূরুল কবীরের সাক্ষাৎকারটি ২০২৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নিউ এজে ছাপা হয়। গত ৯ই মে নিউ এজের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ইউনূস আন্ডার ক্রিটিসিজম ওভার প্রিভিলাইজেস’, অর্থাৎ ‘সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সমালোচনার মুখে ইউনূস’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতায় থাকাকালীন বিশেষ সুবিধা নেওয়ায় ড. ইউনূস সম্প্রতি সমালোচনার মুখে পড়েছেন। 

নূরুল কবীর মনে করেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার তুলনায় সাধারণভাবে অবশ্যই সম্প্রসারিত হয়েছে। ... পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না।' এমন পরিস্থিতিতে মাহফুজ আনাম কেন এক এগারোর ভূমিকার পথে হাঁটছেন, এ প্রশ্ন অনেকের।

২০১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর মাহফুজ আনাম প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে ব্যাপক স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি, সেই তুলনায় এর দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বিরাট। সাংবাদিকতায় যেটাকে বলা হয় এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা নেই। ফলে এ মাধ্যমে খবর আদান–প্রদানের অভিজ্ঞতায় লোকজন আস্থার সংকটে ভোগে।’ শুধু সামাজিক মাধ্যম নয়, দলবাজ সম্পাদকদের লেখা পড়েও পাঠকরা আস্থার সংকটে ভোগেন বলে অভিজ্ঞদের অভিমত।