Image description
সংকট উত্তরণে বিশ্লেষকদের অভিমত । নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাই সবচেয়ে বড় দাবি, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনতে পুরো জাতি অধীর অপেক্ষায় । রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে বৃহত্তর স্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত সহজে নেওয়ার আহ্বান। 

চলমান সংকট থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে এখন আর তেমন কিছু নেই। আলোচনা ও দাবিদাওয়া পেশ শেষ। এখন সরকার তথা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনতেই অধীর অপেক্ষায় পুরো জাতি। এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুগান্তরের কাছে কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমন মন্তব্য করে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি-বল এখন সরকারের কোর্টে। সরকারকেই জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমাধান দিতে হবে।

তারা বলেন, পক্ষে-বিপক্ষে যত মত ও যুক্তি থাকুক না কেন-রাগ, বিরাগ ও আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে সবার আগে দেশের স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে জবাব দিতে হবে। তারা মনে করেন, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থানের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এক কথায় বলা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের ১০ মাসের মাথায় সরকারের জন্য সময়টি বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের বিষয়। এমন পরিস্থিতির জন্য কে কতটুকু দায়ী সেদিকে বিতর্ক উসকে না দিয়ে যে কোনো মূল্যে জুলাই ঐক্যকে ধরে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতে ফ্যাসিবাদ যাতে পুনরায় ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই সঙ্গে ঐক্যমতে পৌঁছাতে সব পক্ষকে কম-বেশি ছাড় দিতে হবে।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক পর্ব শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সব পক্ষই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বহাল রেখেই নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে চায়। এ পর্যন্ত যত দাবি সামনে এসেছে তার মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণই অন্যতম দাবি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে-সংস্কার, বিচার এবং কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ ইস্যু। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী স্টেকহোল্ডার বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলেও জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগের অবস্থানে অনড়। তারা প্রফেসর ইউনূসের ‘ডিসেম্বর-জুন’ নির্বাচনি রোডম্যাপ সমর্থন করলেও জুলাই ঘোষণাপত্র, মৌলিক সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে বেশ অনড়। এক কথায় দাবি আদায়ের প্রশ্নে কেউ কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দিতে চায় না।

এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সংকট উত্তরণে খুবই সোজা পথ হচ্ছে-কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটা পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। যদি ৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারে, তাহলে এ সরকার কেন এত সময় পার করে ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে পারবে না। নির্বাচনের দিনক্ষণ তো এখন কেউ চাচ্ছে না। এটি নির্বাচন কমিশনের তফশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসবে। কিন্তু মাসটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বলা, ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন’ এটা কোনো প্রতিশ্রুতি হতে পারে না। এতটা সময় নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। ফলে দেশের বেশিরভাগ জনগণ যে সময়ের মধ্যে নির্বাচন প্রত্যাশা করে সে সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এটা ক্লিয়ার করলে কিন্তু সংকটের ৮০ ভাগ এমনিতেই দূর হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের কাছে গিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে এসেছে। এখন নির্বাচনসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে সুস্পষ্ট জবাব আসতে হবে। দেশবাসী সে অপেক্ষায় রয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আন্দোলন আর দাবি পূরণে ব্যস্ত সময় পার করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে দূরত্বও তৈরি হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গেও। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যু। এতকিছুর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল পদত্যাগ করতে চান প্রধান উপদেষ্টা। অবশ্য পরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা পরিষ্কার করেন, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক সমস্যা ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও বিচারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের অভিন্ন দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।

জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে কোনো আশ্বাস কিংবা প্রতিশ্রুতি দেননি। ফলে প্রধান উপদেষ্টার আশানুরূপ জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক দলগুলোসহ দেশের মানুষ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান যুগান্তরকে বলেন, সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ ঐকমত্য। যে কোনোভাবেই হোক জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে এবং সব পক্ষের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কোথাও ছাড় দেব না-প্রত্যেকে এমন অবস্থান রাখলে জাতীয় ঐকমত্য হবে না। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে এখন জাতীয় ঐকমত্য হওয়া খুব জরুরি। একটা ভালো নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এসব সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এজন্য কিভাবে একটা ভালো নির্বাচন করা যায়, সে লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, বল সব সময়ই সরকারের কোর্টে থাকে। কারণ সরকারই হচ্ছে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। সুতরাং সরকারকেই সব দায়-দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করার সামর্থ্য নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের ভিত্তিতে। কিন্তু এটা সরকার বুঝতে পারছে না। প্রথমত, এর জন্য সরকার দায়ী। সরকার নিজে নিজে কাজ করার চেষ্টা করছে। সরকার ভাবছে নিজেরাই সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার চাইলেই সব কাজ নিজেই করে ফেলতে পারে না। কিছু বিষয়ে দেশের মানুষের আস্থা অর্জনের ম্যান্ডেট নিতে হয়। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে যারা সরকারকে সমর্থন দিয়েছে তাদের যদি সরকার এখন আস্থায় রাখতে না পারে তাহলে এ ধরনের সংকট কাটবে না। তিনি বলেন, চলমান সংকট উত্তরণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা আপসে আসতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে আবেগ-অভিমান ভুলে বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।