
কোরবানি ঈদে পশুর হাট ও কাপড়ের মার্কেটকে টার্গেট করে সক্রিয় হয়েছে জাল নোটের কারবারিরা। দেশ জুড়ে তারা তাদের তৎপরতা শুরু করেছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বিভিন্ন সময় আটক হওয়া জাল নোটের কারবারিরা জামিনে বের হয়ে এসে আবারো এই পেশায় জড়াচ্ছে। এরসঙ্গে নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা যুক্ত হচ্ছেন। বাসাবাড়ির মধ্যে তারা ছোট ছোট প্রিন্টার ও কম্পিউটার নিয়ে এসব কাজ করছে তারা। দ্রুত ও নিখুঁত জাল নোট তৈরি করতে এই চক্রের সদস্যরা বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করছে। তারা এখন ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ২০০ ও ৫০ টাকার নোটও জাল করছে। তারা এতটাই দক্ষ যে তাদের জাল করা নোট হুবহু আসল টাকার মতো দেখতে। যে কেউ হঠাৎ করে হাতে নিয়ে চিনতে পারবে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই জাল নোট পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের মূল মৌসুম হচ্ছে এই কোরবানির ঈদের পশুর হাট ও বড় বড় বিপণিবিতানগুলো। আর এইসব কারবারিদের সঙ্গে কিছু আইনজীবীও জড়িত রয়েছেন। যারা মোটা টাকার বিনিময়ে তাদেরকে সহজেই জামিন পাইয়ে দেয়ার কাজ করে। তাই এদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পরলেও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৬ই মে দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওয়ারী থানাধীন আর কে মিশন রোডের ৮ নম্বর গলির ৬তলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ মো. সাইদুর রহমান (৩২) ও মো. মেহেদী হাসান (২৫) নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট (১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট), ৭৭ হাজার ১০০ ভারতীয় রুপির জাল নোট, একটি সিপিইউ ও মনিটর, প্রিন্টারের ৮টি কালির কৌটা, ১০০ পিস ফয়েল পেপার (সিকিউরিটি ফিতা), দু’টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জানিয়েছে, আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে তারা বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মজুত রেখেছিল। এর দুইদিন আগে গত ১৩ই মে সকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবির সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের একটি দল রাজধানীর মহাখালী পুলিশ বক্সের সামনে অভিযান চালিয়ে জাল নোট বেচাকেনায় যুক্ত সাইফুল ও রেজাউল নামে দু’জনকে আটক করে। ওই সময় তাদের কাছ থেকে চার হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
এরপর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন বুধবার রাতে পঞ্চগড় সদর থানার ব্যারিস্টার বাজার এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাইদুর, সোহেল, মাহমুদ ও শাহ্ আলম নামে আরও ৪ জনকে আটক করা হয়। এরপর সবুজ ও সোহেলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৮২ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, জাল নোট বিক্রির নগদ ২ লাখ ১৪ হাজার টাকাসহ জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তারাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন-কোরবানি ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল তাদের। গত ৯ই মে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকেও ৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোটসহ লাবনী বেগম (৩২) ও রাজন শিকদার ওরফে শুক্কুর ওরফে রাজু (৩৩) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডেমরা থানা পুলিশ। থানা পুলিশ জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটের দিকে সেখানে পৌঁছে পুলিশ এক নারীকে (লাবনী বেগম) দেখতে পায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কৌশলে পালানোর চেষ্টাকালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার হেফাজত থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়। পরে লাবনীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডেমরার রসুলনগর সারুলিয়া এলাকার একটি ভবনের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে রাজন শিকদার ওরফে শুক্কুর ওরফে রাজুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে ৮ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তারেক দত্ত বলেন, জাল টাকা কম-বেশি সব সময়ই ছিল। কিন্তু এই কোরবানি ঈদের আগে জাল টাকার আধিক্য অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। সাধারণত পশুর হাট ও বিপণিবিতানগুলোতে এখন নগদ টাকায় লেনদেন বেশি হচ্ছে। আর এই সুযোগেই প্রতারকরা জাল টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেখানে ধরা খাচ্ছে সেখানে পাল্টে দিচ্ছে, আর ধরা না খেলে কৌশলে জাল নোট চালিয়ে দিচ্ছে। আমরা নিয়মিতই এই জাল টাকা হাতে পাচ্ছি। আমাদের হাতে আসামাত্রই ব্যাংকিং সিস্টেম অনুযায়ী জাল নোটগুলো আমরা ছিদ্র করে তা নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছি। কিন্তু অনেক সময় আছে কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ আসেন আমাদের কাছে। তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না কোনটা জাল আর কোনটা আসল। কিন্তু আমরা যখন তাদের জমা করতে দেয়া জাল নোটগুলোকে শনাক্ত করি তখন তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। হতাশ হয়ে অনেক সময় ব্যাংককর্মীদের ওপর চটে ওঠেন। আমরা তখন তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যেন এমন জাল টাকা নিয়ে প্রতারণার শিকার না হয় এজন্য সতর্ক করে তাদেরকে টাকা চেনার কৌশল বলে দিই। এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, এই জাল নোট তৈরিতে অনেক মানুষ জড়িত। কেউ নিজ বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই ব্যাবসা করে। কেউ বাসা ভাড়া নিয়ে করে। আর কুরিয়ার সর্ভিসের পার্সেল পুলিশের চেক করার অনুমতি না থাকার সুযোগে অনলাইন ব্যাবসায়ীদের মতো তারা পার্সেলের মাধ্যমে জাল নোট দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খুব সহজেই ছড়িয়ে দিচ্ছে। এদের মধ্যে যারা কয়েকবার আটক হয়ে যারা মার্কামারা হয়ে গেছে তাদেরকেই শনাক্ত করা যাচ্ছে। বাকি সিংহভাগই থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, আসন্ন ঈদুল আযহাকে ঘিরে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জাল নোটের বিষয়েও আমাদের বিভিন্ন টিম কাজ করছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাল নোট ও এই নোট তৈরির সরঞ্জামসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। মামলাও হয়েছে। অনলাইনেও আমাদের নজর রয়েছে। এই জাল নোটের কারবারিদের ধরতে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদেরকেও সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।