Image description
আজ দুই মন্ত্রণালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে বৈষম্য বিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনে ফ্যাসিষ্ট স্বৈরাচার আওয়ামী-লীগের দোসরদের অপসারণ এখনো করতে পারেনি অন্তর্বকার্লীন সরকার। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। ফ্যাসিস্টবাদি আমলাদের অপসারণ এবং চুক্তিভিত্তিক-দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণে সরকারের উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তারা বার বার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অপর সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্তে অধ্যাদেশের বিধান অনুমোদন করার পরে একের পর এক আন্দোলন, দাবি-দাওয়ায় বেসামাল অবস্থা হয় প্রশাসনের। অবরুদ্ধ করার ঘটনাও ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে কিছু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনে শৃঙ্খলা এখনো ফেরেনি। এর মধ্যেই নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে প্রশাসন এখন উত্তাল। অন্যদিকে ছাত্র-জনতা,জুলাই ্ঐক্যসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনের পর দিন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দোসর মুক্ত জনপ্রশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামও এই দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে আন্দোলন করে যাচ্ছে।

পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাক্ষাত করে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দোসর ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণের অনুরোধ জানিয়ে তালিকা প্রদান করেছে। তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আজ রোববার সকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতারা গতকাল শনিবার সংগঠনের সদস্য সচিব কাজী মেরাজ হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রশাসনে কর্মরত থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং চুক্তিভিত্তিক-দূর্নীতিবাজ সচিবদের নিয়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্য বিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতারা দাবি জানিয়েছে আসছে। ইতোমধ্যে ফ্যাসিস্ট সরকারে আমলে নিয়োগ পাওয়া ৪৪জন সচিব এবং ৯৫ ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা প্রকাশ করেছে জুলাই ঐক্যে। তারা বলেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পরও দলটির দোসররা প্রশাসনে এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। গত সাড়ে ১৫ বছর বিভিন্নভাবে যেসব আমলা ও ম্যাজিস্ট্রেটরা শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেসব সচিব -ম্যাজিস্ট্রেটদের তালিকা প্রকাশ করেছে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণকারী ৮০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত সংবলিত প্ল্যাটফর্ম জুলাই ঐক্য। আগামী ৩১ মে এর পর ছাত্রজনতা এবং জুলাইয়ের স্পিরিট ধারণকারী সকল সংগঠনকে নিয়ে মার্চ টু সচিবালয়সহ আরও কঠোর কর্মসূচি পালন করে তা ঘোষণা দিয়েছে।

গতকাল শনিবার সকাল থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিছিল-স্লোগানে সরব সচিবালয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্তে অধ্যাদেশের বিধান বাতিল না করলে সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী বড় পরিসরে আন্দোলনে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফের অবরুদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ডিসি নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল। কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিছিল করছেন, অবস্থান নিচ্ছেন। আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। তারা মানববন্ধন করে কর্মবিরতির আলটিমেটাম দিয়েছেন। অন্যদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনও চলমান। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেতৃত্ব দুর্বলতায় সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্যে ঘাটতি রয়েছে। দুর্বলতা বুঝে ফেলায় কোনো পক্ষই আর সরকারকে পাত্তা দিচ্ছে না। সরকার কঠোরতা দেখাতে না পারায় প্রশাসনে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। কারণ অধ্যাদেশের খসড়ায় শৃঙ্খলা বিঘিœত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কাজে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানির জন্য কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’র খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চারজন উপদেষ্টাকে। তবে অধ্যাদেশের এ খসড়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

গতকাল শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে সচিবালয়ে মিছিল করেন। তারা মিছিল নিয়ে সাক্ষাৎ করেন আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিবের সঙ্গে। এরপর তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে যান। তারা অধ্যাদেশ থেকে নিবর্তনমূলক ধারা (এমন আইন বা ধারা যা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত করে) বাতিলের জন্য দুই সচিবকে অনুরোধ জানান। নতুন অধ্যাদেশের খসড়ার বিরোধিতা করে এর আগে গত ২১ মে যৌথ বিবৃতি দেয় সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একটি অংশ (নুরুল ইসলাম) ও আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন। বিবৃতিতে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১’ সংশোধন করে ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’-তে বর্ণিত অপরাধ, দ- ও শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়।

গত ২২ মে সংযুক্ত বাদিউল কবীরের গ্রুপ অধ্যাদেশের নিবর্তনমূলক ধারার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়। সেখানে এ নিবর্তনমূলক কালা-কানুন সংযোজন থেকে সরে এসে স্বাভাবিক পন্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা প্রদর্শন ও বিরাজমান কর্মচারী অসন্তোষ থেকে সরকারের প্রতি বিরাজিত পূর্ণ আস্থা সমুন্বত রেখে কর্মচারীদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় কার্যক্রম নিষ্পন্নের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সম্পর্কের অবনতি হলে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদগার করতে থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অনেককে সাময়িক বরখাস্ত করে, কারও কারও বিরুদ্ধে হয় বিভাগীয় মামলা। ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, একতরফাভাবে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের অবস্থান কর্মসূচিতে গত ১৩ মে অচল ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হককে সারাদিন অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। হেনস্তার শিকার হন ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনমও। তাকে হেনস্তার পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাদের দাবি, স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার শেখ হাসিনা বিদায় হলেও প্রশাসনে বহাল আছে তার দোসররা। একই সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু সুবিধাভোগী মতলববাজ কর্মকর্তা। তারা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করছে। ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ও লুটেরা ওইসব কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। জনপ্রশাসন সচিবসহ চুক্তিভিত্তিক কাজে নিয়োজিত সবার চুক্তি বাতিল করতে হবে। ওইদিন ঐক্য ফোরামের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক সচিব আবদুল খালেকের নেতৃত্বে ৩৫ থেকে ৪০ জন কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দপ্তরে অবস্থান করেন। তাদের অবস্থানের ফলে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এপিডির দপ্তর। এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত হওয়া কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে অবরুদ্ধ করেছিলেন।ওইদিন তারা সচিবালয়ে মিছিলও করেন। এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন,অন্তর্বর্তী সরকারের যে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেখানে তারা চরমভাবে ব্যর্থ। এ কারণে সব জায়গায় অস্থিরতা। কারণ সরকার নেতৃত্ব দিতে পুরোপুরি ব্যথর্।