
দেশের যে শিল্পগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছে, তার মধ্যে ওষুধ শিল্প অন্যতম। দেশের ৯৮ ভাগ ওষুধের চাহিদা পূরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে, আয় হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু সেই ওষুধ শিল্পের অগ্রযাত্রা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অর্ধশত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় না করা, আইনগত সুবিধা প্রদান না করা এবং লোকসানে ওষুধ বিক্রিতে বাধ্য করাসহ নানা কারণে ওষুধ শিল্প ঝুঁকিতে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের বিকাশমান ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত এবং উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে বেশি দামে আমদানি করে ওষুধের চাহিদা মেটাতে হবে, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত পলিসি তারা নিজেরাই মানছে না। আইন অনুযায়ী প্রতি বছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দাম সমন্বয়ের কথা থাকলেও সেটা হয় না। দেশীয় ওষুধ উৎপাদকরা গড়ে ২০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে বিক্রি করছেন। এসব ওষুধের মধ্যে সরকার ঘোষিত ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ রয়েছে। প্রতি ইউনিট লোকসান দিয়ে মানবিক বিবেচনায় এখনো উৎপাদন করা হচ্ছে; কিন্তু বেশিদিন এভাবে লোকসান অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
দাম বাড়ার কারণ: দেশের শীর্ষ ওষুধ উৎপাদক একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণন প্রধান বলেন, ওষুধের উৎপাদন ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কিন্তু সরকার দাম সমন্বয় করতে দিচ্ছে না। ওষুধের দাম বাড়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভ্যাট সার্টিফিকেট ইস্যু না করা। চলতি বছরেই ডলারের দর বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। দ্বিগুণ বেড়েছে গ্যাস, ইলেকট্রিসিটির মূল্য, ব্যাংক ঋণে সুদের সিঙ্গেল ডিজিট থেকে ডাবল ডিজিটে উঠেছে। কর্মীদের বেতন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ ডিউটি দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিকমানে পণ্য উৎপাদন করায় কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টে ব্যয় অনেক বেশি। আমদানিনির্ভর প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালও ওষুধের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। কোম্পানিভেদে দাম বাড়ার আরেকটি কারণ ইনগ্রেডিয়েন্ট আমদানির পরিমাণ; একশ কেজি কাঁচামাল আমদানি মূল্য আর এক হাজার কেজির আমদানি মূল্য দৃশ্যত প্রতীয়মান। এ ছাড়া বায়োইকুইভেলেন্স নিশ্চিত করতে ওষুধের দাম আরও বাড়বে। একটা ওষুধের বায়োইকুইভেলেন্স করতে ৩ থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়, যা ওষুধের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬০০ ব্র্যান্ডের ওষুধের মূল্য সমন্বয়ের অনুরোধ করেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টির মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে ওই ওষুধগুলোর দাম বেশি বাড়ানো হয়।
স্যালাইন উৎপাদন হ্রাস: ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মাধ্যমে ২০ লাখ ব্যাগ আইভি ফ্লুইড (নরমাল স্যালাইন ১০০০ মিলি ও গ্লুকোজ স্যালাইন ১০০০ মিলি) সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে কিনতে ক্রয় প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন চাওয়া হয়। ক্রয় প্রস্তাবে বলা হয়, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় গত ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় জরুরি পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ব্যাগ আইভি ফ্লুইড (নরমাল স্যালাইন ১০০০ মিলি এবং গ্লুকোজ স্যালাইন ১০০০ মিলি) কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই আলোকে এরই মধ্যে পিপিআরের (সরকারি ক্রয় বিধিমালা) বিধিবিধানের আলোকে তিন লাখ ব্যাগ আইভি ফ্লুইড সরাসরি কেনা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমবে; কিন্তু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বিস্তার আরও বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে দেশে আইভি ফ্লুইডের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার্থে জরুরি প্রয়োজনে আরও ২০ লাখ পিস আইভি ফ্লুইড সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে কেনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিশেষ ব্যয় খাতের বরাদ্দ অর্থ থেকে এ ব্যয় বহন করা হবে। প্রস্তাবিত ২০ লাখ পিস স্যালাইন কেনার আনুষঙ্গিক খরচসহ সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। প্রতিটি স্যালাইনের দাম পড়বে ১৪৫ টাকা ৯৫ পয়সা। ভারতে এই স্যালাইনের (৫০০ মিলি) দাম ২৮ রুপি অর্থাৎ ৩৬ টাকা এবং ১০০০ মিলি স্যালাইনের দাম ৪৭ রুপি অর্থাৎ ৬০ টাকা ৬৩ পয়সা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, জরুরি স্বাস্থ্যপণ্য হিসেবে এই স্যালাইন আমদানিতে কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে না। পরিবহন ব্যয়, কাস্টমস শুল্ক ও ঠিকাদারের লাভ যুক্ত করে স্যালাইনপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ৮৬ টাকা। অথচ দেশের বেসরকারি কোম্পানির উৎপাদিত স্যালাইনের দাম রাখা হয় ৯০ থেকে ১১০ টাকা।
তুলনামূলক চিত্র: সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের চেয়ে কম মাথাপিছু আয়ের পাঁচটি দেশেও ওষুধের দাম তুলনামূলক বেশি। যেখানে বাংলাদেশে একটি মন্টেলুকাস-১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ১০ টাকা থেকে ১৭ টাকা, সেখানে নাইজেরিয়ায় এটি ৬১ টাকা, নেপালে ১৩ টাকা, মিয়ানমারে ১৫ টাকা, পাকিস্তানে ১৬ টাকা এবং ভারতে ২৩ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেশি এমন পাঁচটি দেশের মধ্যে এ ওষুধটির দাম শ্রীলঙ্কায় ১৮ টাকা, ফিলিপাইনে ২৭ টাকা, ভিয়েতনামে ২৪ টাকা, মালয়েশিয়ায় ৪৩ টাকা এবং সৌদি আরবে ৬১ টাকা। এইকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাজিথ্রোমাইসিন ৫০০ মিলিগ্রাম একটি ট্যাবলেট বাংলাদেশে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে উল্লিখিত দেশগুলোয় এর দাম যথাক্রমে ১৪৯, ৪০, ৪৬, ৪৯, ৪৩, ৬১, ১০১, ৮৯, ৮১ এবং ১৪৯ টাকা। (ডলার ২১২.৫ টাকা হিসাবে)।
এমনকি পাশের দেশ ভারতেও ওষুধের দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০ মিলিগ্রাম একটি পেন্টাপ্রাজল দেশে ৭ টাকা, ভারতে ৯ টাকা; প্যারাসিটামল সিরাপ ১০০ এমএল বোতল দেশে ৫০ টাকা, ভারতে ৮৭ টাকা; বেকলোপেন ১০ মিলিগ্রাম দেশে ৮ টাকা ভারতে ১৭ টাকা। এমনকি অ্যান্টিক্যান্সার ড্রাগ পেমব্রোলাইজুমাব ১০০ মিলিগ্রাম এক ইউনিটের দাম বাংলাদেশে ৬০ হাজার টাকা, ভারতে তা ২ লাখ ৮০ হাজার ৩৩১ টাকা। (রুপি ১.৪২৩ টাকা হিসেবে)
আইনে কী আছে: ১৯৯৪ সালের ‘ওষুধের কাঁচামালের ব্লকলিস্ট এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক স্মারকের ১ (খ)তে বলা হয়েছে, ‘তালিকা বহির্ভূত ওষুধের নির্দেশক দাম নিজ নিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে এবং ওই ওষুধের আউটার কার্টনের গায়ে মুদ্রিত থাকবে। নির্দেশক মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে কোনো ওষুধ বিক্রি করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে দেশের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী যে কোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ওষুধের দাম কম। কিন্তু ডলার রেট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ওষুধের কাঁচামাল ও প্যাকেজিং ব্যয়। খাদ্য, বস্ত্রের দাম বাড়ায় বাড়ছে জীবনযাপন ব্যয়। কোনো কিছুর দামই সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে না। শুধু ওষুধের দাম বাড়ানোর কথা বললেই সরকার সেটা আটকে দিচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগে ২০২৩ সালে সরকার দেশীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে ১০০ টাকায় স্যালাইন না কিনে ১৪৬ টাকা দরে বিদেশ থেকে স্যালাইন আমদানি করে। এতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের মাত্র চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান স্যালাইন উৎপাদন করে, উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। সরকার যদি ওষুধের যৌক্তিক দাম না বাড়ায়, তাহলে মানবিক কারণে লোকসান দিয়ে ওষুধের উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। এতে ওইসব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিদেশ থেকে বেশি দামে আমদানি করতে হবে। ফলে দেশের ওষুধ খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে উৎপাদতি ওষুধের আর্থিক মূল্য ৩ বিলিয়ন ডলার। আমদানীকৃত ওষুধের ক্ষেত্রে এই মূল্য দাঁড়াবে ৯ বিলিয়ন ডলারে।
মামলা চলমান: দেশে ওষুধের মূল্য বেশি অভিযোগে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দুই মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। তবে সে সময় অনেক আগে অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মূল্য সমন্বয় কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতের স্থগিতাদেশের সময় শেষ হলেও মামলা এখনো চলমান এবং শুনানি চলছে। তাই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, দেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭০ ভাগই রোগীর পকেট থেকে ব্যয় হয়। এ ব্যয়ের দুই তৃতীয়াংশ ওষুধের পেছনে। এভাবে স্বাস্থ্য ব্যয় বহন করতে গিয়ে বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়। ন্যায়সংগত মুনাফার সুযোগ রেখে মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি যৌক্তিকভাবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হলে দেশের জনগণের জন্য সেটি কল্যাণকর হবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ অফিসের সহযোগিতায় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটি হালনাগাদ করা হলে নতুন তালিকার আলোকে সরকারি প্রতিষ্ঠান, তার সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করবে।