
জাতীয় নাগরিক পার্টির নির্বাচন কমিশন অফিস ঘেরাও, ডিএসসিসির মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচারসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত। এরই মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (তৎকালীন দুদক সচিব) মোখলেস উর রহমানসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ৪৪ জন সচিব ও ৯৫ জন ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা প্রকাশ করেছে ‘জুলাই ঐক্য’ নামের একটি সংগঠন। সব মিলিয়ে চাপে পড়েছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে ফের আন্দোলনে নেমেছে একাধিক সংগঠন। আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের দ্রুত অপসারণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, অবসরপ্রাপ্ত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গঠিত অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন কমিটি বাতিলের দাবিতে সোচ্চার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। পাশাপাশি সচিবালয় নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) হিসেবে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি এবং দ্বিতীয় শ্রেণির এও-পিও ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও সচিব পদবির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। অবসরে যাওয়া সাবেক কর্মকর্তারাও বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
এদিকে আন্ত ক্যাডার বৈষম্য দূর করার দাবিতে নানা কর্মসূচি চলমান রেখেছে ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। তদন্ত ছাড়া চাকরিচ্যুতির বিধান যোগ করে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন প্রতিরোধেও একাট্টা সরকারি কর্মচারীরা। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের কলমবিরতি চলছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন পক্ষের দাবিদাওয়ায় উত্তপ্ত সচিবালয়, আর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জনপ্রশাসন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন চিত্র। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি জনপ্রশাসনসচিব ড. মোখলেস উর রহমান।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (তৎকালীন দুদক সচিব) মোখলেস উর রহমানসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত ১৯ মে মামলা করেছেন হারুন অর রশিদ নামের এক ব্যক্তি। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালত মামলাটির আদেশের তারিখ ধার্য করেছেন ২৫ মে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরী, তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নান।
এদিকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বর্তমানে কর্মরত পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ৪৪ জন সচিব ও ৯৫ জন ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা প্রকাশ করেছে জুলাই ঐক্য নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটি এসব আমলা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে। ৩১ মের মধ্যে দাবি মানা না হলে মার্চ টু সচিবালয় কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই জনপ্রশাসনসচিবকে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তার ওপর বিএনপির শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর দুই দিনের মাথায় জুলাই ঐক্যের ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তার এই তালিকা নিয়ে বড় ধরনের চাপে রয়েছে সরকারের শীর্ষমহল। কারণ এঁদের অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালীদের রেফারেন্সে কর্মরত। জুলাই ঐক্যের দাবি মানলে বিপদ, না মানলে আরো বড় বিপদ। এর বাইরে প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা ইস্যুতে আন্দোলন চলছেই। এ কারণে মন্ত্রিপরিষদসচিব ও জনপ্রশাসনসচিব নিজ দপ্তরে অফিস না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গিয়ে বসে থাকেন।
জানা গেছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে বিক্ষোভ সমাবেশ বা অফিস ঘেরাওয়ের ঘটনা লেগেই আছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার নন-ক্যাডার কর্মচারীদের জন্য অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ এবং এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করায় অস্থিরতা আরো বেড়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফোরাম এবং অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ এবং বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও কল্যাণমূলক সিভিল সার্ভিস গঠনে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই কর্মসূচি পালন করছে প্রশাসন বাদে বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলমবিরতি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন মহল থেকে ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যায়িত করে সচিবসহ কর্মকর্তাদের নামের তালিকা তৈরি ও পোস্টারিং করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রশাসনে নতুন করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ ছয় দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়নে কমিটি গঠনের বিরোধিতা, পদের নাম পরিবর্তন, সচিবালয় রেশন ভাতা চালু, নবম পে কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েক দিন আগে সমাবেশ করেছে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকটি গ্রুপ।
এদিকে ৩০টি অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সংস্থার কর্মচারীরা তাঁদের পদের নাম বদল করে বেতন গ্রেড উন্নীত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আসা এসব আবেদন পর্যালোচনা করে অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। এমন উদ্যোগে ফুঁসে উঠেছেন সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।