
আগামী ২ জুন টেলিভিশনের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করবেন অর্থ উপদেষ্টা। পরবর্তীতে তা কার্যকর করা হবে অধ্যাদেশ আকারে। ভ্যাট ও শুল্ক তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। প্রতি অর্থবছরে জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ থাকলেও এবার এর ব্যতিক্রম হচ্ছে। অন্য সময় সংসদে বাজেট অধিবেশনে এসব নিয়ে আলোচনা হলেও এবার সংসদ না থাকায় বিভিন্ন আলোচনা, টক শো, বাজেট প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো কিছুর সংযোজন বিয়োজন লাগলে তা করে পরে অর্থ আইন (অধ্যাদেশ) আকারে পাস করা হবে। গত সোমবার বাজেট বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে এক বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান ছাড়াও আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক অনুবিভাগের নীতি শাখার সদস্য, প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিবরা উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বাড়তি শুল্ক কমানোর জন্য আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আসন্ন বাজেটেই অন্তত ১০০ ধরনের আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া আর্থিকখাতে মন্দা ও আগামী বছরে রাজস্ব খুব বাড়বে না তাই অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সময় কালো টাকা দিয়ে বিনিয়োগ করে সুযোগ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত এসেছে। ইতোমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ফ্ল্যাট-প্লটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু নানামুখী সঙ্কট এবং অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করেনি। ফলে সব শ্রেণির ক্রেতাদের মধ্যে সংশয় কাজ করছে বলে উঠে এসেছে সংশ্লিষ্টদের কথায়।
ঢাকার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন টঙ্গীর বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হাই, যিনি দুই বছর আগে অবসরে যান; তার স্ত্রী পেয়ারা বেগমও প্রায় অবসরের দ্বারপ্রান্তে। নিজেদের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছে ছিল তাদের কিন্তু কিনবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছেন এখন।
আব্দুল হাই বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের এই ডামাডোলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফ্ল্যাট কেনার সাহস পাচ্ছেন না। তিনি ও তার আমার স্ত্রী মিলে প্রায় ৬০ লাখ টাকার মত সঞ্চয় করেছেন, তার পেনশন আর সব মিলিয়ে। কিন্তু এই টাকায় কোথাও নতুন ফ্ল্যাট পাচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, ‘এটা তো একটা সমস্যা। পাশাপাশি পুরোনো ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি, আর নতুনের ফি যে একই; এটা আমি জানতাম না। প্রায় ১৫ শতাংশ। সব থেকে বড় কথা হল, এই মুহূর্তে এই টাকায় ফ্ল্যাট কিনে ঝামেলায় পড়ি কি না। এ জন্য কেনা হচ্ছে না।’
সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রেতা-বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা, উচ্চ নিবন্ধন ফি, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধন না করাসহ বেশ কিছু কারণে দেশের আবাসন ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফ্ল্যাট কেনাবেচায় ভাটার কারণ হিসেবে আরও কিছু বিষয় সামনে এনেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নতুন ও পুরনো ফ্ল্যাটের নিবন্ধনের হার একই হওয়ায় বাজার বড় হচ্ছে না।
একই সঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ে বিশেষ করে প্লট-ফ্ল্যাটের বাজারে সংকটের কারণ হিসেবে ঘুরে ফিরে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ বাতিলের কথা বলেছেন এই খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের দাবি, বর্তমানে রাজউকের এই ড্যাপ বৈষম্যমূলক। এটি বাতিল করলে বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাস বাড়বে। সেই সঙ্গে বিল্ডিংয়ের আয়তন (ইউনিট-ফ্ল্যাট) বাড়বে, যার প্রভাবে বাজার সচল হতে শুরু করবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিষদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ অনুসারে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকায় পূর্বে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, এখন তার প্রায় ৬০ শতাংশ পাওয়া যায়। ফলে ডেভেলপাররা নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারছেন না। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি করেন, তারাও প্ল্যান পাস করতে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ অনেক এলাকায় আগে যেখানে আটতলা ভবন তৈরি করতে পারতেন, সেখানে পারবেন চার থেকে পাঁচতলা। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ ও মাস্টার প্ল্যান (ড্যাপ)-২০১০ বিধি অনুসারে ভবনের নকশা অনুমোদনের দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, নানা চড়াই-উৎরাই এবং সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আবাসন খাত এগিয়ে গেলেও সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হয় ২০২২ সালের ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারির পর। ড্যাপ পাসের পর ঢাকা শহরের উন্নয়ন একেবারেই থমকে গেছে, যার কারণে আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। তিনি বলেন, একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ কে উপেক্ষা করে ও মাস্টার প্ল্যান-২০১০ কে অন্যায়ভাবে রহিত করা হয়। এর ফলে, আগামী এক বছর পর থেকে সংকট আরও মারাত্মক হবে এবং আবাসন শিল্প একেবারে কোমায় চলে যাবে বলে শঙ্কা তার।
শুধু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল হাই এই নয়; জীবনযাত্রায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে সঞ্চয় ভেঙে ফ্ল্যাট কেনায় এই মুহূর্তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই। আবার চলতি অর্থবছরে ফ্ল্যাট-প্লটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগের যে সুযোগ রাখা হয়, সংস্কারমুখী অন্তর্বর্তী সরকার যে বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করেনি। ফলে সব শ্রেণির ক্রেতাদের মধ্যে সংশয় কাজ করছে বলে উঠে এসেছে সংশ্লিষ্টদের কথায়। তারেদ মতে, ফ্ল্যাট ও জমি কিনলেই দুদক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সংস্থার হয়রাণির পাশাপাশি ড্যাপ জটিলতা ও উচ্চ নিবন্ধন ফিতে বিপর্যস্ত সবাই।
গত সোমবারে বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, খুব বেশি রেভিনিউ আসবে না, সরকার বিপাকে পড়তে পারে, সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে, সেসব জায়গায় কর না বসাতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বাড়তি শুল্ক কমানোর জন্য আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আসন্ন বাজেটেই অন্তত ১০০ ধরনের আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে যাচ্ছে সরকার। বৈঠকে উপস্থিত এনবিঅর’র এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা ১০০টি ট্যারিফ লাইনের পণ্যে শুল্ক শূন্য করার প্রস্তাব করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির বিষয়টি মাথায় রেখে। তখন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় কীভাবে সম্ভব? আমরা বলেছি, এটা সম্ভব না। তবে আমরা বিশ্লেষণ করেছি এসব পণ্যে শুল্ক ছাড় দিলে তার সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রই পাবে। এক বা একাধিক সমজাতীয় পণ্যের নির্দিষ্ট শুল্ক হার ঠিক করা হয় ‘ট্যারিফ লাইন’ বা এইচএস কোড দিয়ে। তার মাধ্যমেই আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন হয়। তেল, গ্যাস, অস্ত্র, ফাইটার বিমানের পার্টস, মিসাইল এমন ১৫-১৬টি পণ্যও এর মধ্যে রয়েছে, যা কেবল সরকার কেনে। আর সরকারি কেনাকাটার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব বলে ওই কর্মকর্তার ভাষ্য। তিনি বলেন, অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান, মিসাইল জাতীয় পণ্য সরকার কিনলে তখন চুক্তির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকে। ফলে রাজস্ব হারানোর শঙ্কা থাকে না।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এদেশে আসে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমদানি রফতানির ব্যবধান ঘোচাতে গত এপ্রিলে বিশ্বের শতাধিক দেশের ওপর বড় অংকের শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর আগে থেকেই ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। আরও ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে সব মিলিয়ে ৫২ শতাংশ শুল্কের হুমকিতে পড়ে বাংলাদেশের পণ্য।
বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়। এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান প্রধান উপদেষ্টা। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। বাংলাদেশের মত অনেক দেশই শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেন দরবার শুরু করে। কোনো কোনো দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক হার শুন্যের ঘরে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশ আগে থেকেই ১৯০ ধরনের পণ্যের শুল্কহার শূন্য রেখেছে। এবার আরও ১০০ ধরনের পণ্য সেই তালিকায় যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে।
এক সপ্তাহের মাথায় নতুন ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার কথা বলেন। আর অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তা তিন মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন। এই সময় দেশগুলোর পণ্যে ন্যূনতম ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপিত হবে বলে জানান।
বৈঠকে আরো যা যা সিদ্ধান্ত
আসন্ন বাজেটে খুব বেশি রেভিনিউ আসবে না, সরকার বিপাকে পড়তে পারে, সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে, সেসব জায়গায় কর না বসাতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেজন্য বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রসঙ্গ এসেছে এবং করপোরেট কর হার অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হলেও শর্ত পালনে কিছু শিথিলতার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় বলে জানান এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা মৎস্য, ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ দেখিয়ে কর ছাড়ের সুবিধা নিয়েছেন। ওই সুযোগ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। করপোরেট কর হার না বাড়লেও টার্নওভার কর দ্বিগুণ, ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ কর ৫ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ কর ৩০ শতাংশে উন্নীত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।