
এমন কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম নেই যা বিগত সরকার আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে হয়নি। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব, পেশ ইমাম নিয়োগ থেকে শুরু করে সংস্থার বদলি-পদোন্নতি, ক্রয়-বিক্রয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের দোকান বরাদ্দ, মসজিদ পরিচালনাসহ সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। তৎকালীন দীর্ঘ সময়ে দায়িত্বে থাকা মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার সুবাদে সব ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের নয় মাস পর গত সপ্তাহে ধর্ম মন্ত্রণালয় ১৫ বছরে ওই সব দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্তে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সংস্থার অর্গানোগ্রামে কোনো পদ ছিল না, সৃজন করাও হয়নি। তবু কাল্পনিক পদ সৃষ্টি করে ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির পাঁচ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঘটনার এখানেই শেষ হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার এক মাস পর সংস্থার সচিবের নামে একটি সংবাদপত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যা দেখে বিস্মিত হন খোদ তৎকালীন সচিব। এনিয়ে দৈনিক মানবজমিনে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গায়েবি নিয়োগ’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ব্যাপক তোলপাড় হলেও প্রতিকার হয়নি। কারণ নিয়োগপ্রাপ্ত ওই পাঁচ কর্মকর্তা ছিলেন ফ্যাসিবাদের দোসর সাবেক মহাপরিচালক সামীম আফজালের নিকটজন। ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি ছাপাখানা ক্রয়বাবদ পৌনে ২ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পড়ে। এ সময় সংস্থার সংক্ষুব্ধ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। ওই সালের ২৮শে ডিসেম্বর দৈনিক মানবজমিনে ‘৩৬ লাখ টাকার ছাপাখানা কিনে ২ কোটি টাকার বিল’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একই ভাবে এই ঘটনাটিও চাপা পড়ে যায়। এ ছাড়া ৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পালিয়ে যাওয়া জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব রুহুল আমিনের নিয়োগ, তার আগে তিনজন পেশ ইমামের নিয়োগের বেলায়ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে। এসব বিষয় আদালত পর্যন্ত গড়ালেও প্রতিকার হয়নি। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের দোকান বরাদ্দের বেলায়ও বেশ অনিয়মের অভিযোগ উঠে তখন। এ সময় মসজিদ মার্কেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদারের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে।
ইউনূসবিরোধী পাঁচ লাখ বুকলেট: বিগত আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসবিরোধী প্রচারণায় এক নতুন কৌশল নেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এসময় সম্পৃক্ত করা হয় দেশের প্রায় তিন লাখ মসজিদের ইমামদের। এজন্য তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় ১৬ পৃষ্ঠার একটি বুকলেট। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিজস্ব প্রেস থেকে এই বুকলেট ছাপা হয়েছিল। বিতরণের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এই ধর্মীয় প্রচার-প্রকাশনা সংস্থার জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। কিন্তু বুকলেটের গায়ে লেখা ছিল ‘আনজুমানে খাদেমুল তরীকাহ, ঢাকা নামে একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নাম। এতে বুকলেটটি বিতরণ করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাঠকর্মীরা। তারপরও চাকরির স্বার্থে বিভিন্ন মসজিদে ড. ইউনূস, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতবিরোধী সমালোচনা সংবলিত বুকলেটটি বিতরণ করা হয়েছিল। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানো এবং একই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিতরণ করা বুকলেটে ‘মুসলমানদের পারিবারিক ও সামাজিক ভিত ধ্বংসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক একটি অধ্যায়সহ ড. ইউনূসবিরোধী কয়েকটি প্যারা ছিল। ১৬ পৃষ্ঠার এই বুকলেটে ড. ইউনূসের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমীর আল্লামা আহমদ শফীরও কঠোর সমালোচনা করা হয়। বুকলেটের নাম দেয়া হয় ‘ওহাবী ইজম প্রতিষ্ঠায় জামায়াতি-হেফাজতি চক্রান্তের কবলে বাংলাদেশ’।
এদিকে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীরকে প্রধান করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিগত দিনের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গত বুধবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাখাওয়াত হোসেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গত ৬ই এপ্রিলের একটি স্মারক এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গত ১১ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ২২৮তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে বিগত সরকারের আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।