ঢাকা যেন এক দাবি আদায়ের শহরে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই নগর জুড়ে দাবি আদায়ের মিছিল। সড়ক বন্ধ করে, অবস্থান অবরোধে সীমাহীন দুর্ভোগ ডেকে আনছে সাধারণ নগরবাসীর। সড়ক বন্ধ করে সভা সমাবেশে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও কেউ মানছেন না, কেউ মানাতে পারছেন না তা। কথায় কথায় দাবি নিয়ে সড়কে নামার এই প্রবণতা ৫ই আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে বেড়েছে। এই দাবির মিছিলের কারণে নগরবাসীর জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। শুরুতে আন্দোলনের বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে পরে দাবি মেনে নেয়ার সরকারি প্রবণতার কারণে এই দাবির মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আন্দোলন করলেই সরকার দাবি মেনে নেয় এমন ধারণা থেকেই এখন যে কেউ দাবি আদায়ের মিছিলে নেমে পড়ছেন, তৈরি করছেন জনদুর্ভোগ। সর্বশেষ গতকালও রাজধানীর অন্তত ৫টি স্থানে দাবি আদায়ে মিছিল, অবরোধ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এতে ওইসব এলাকায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়।
বেতনের দাবিতে যমুনামুখী যাত্রা, পুলিশি বাধায় কাকরাইলে অবস্থান: বকেয়া বেতন ও অন্যান্য পাওনার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। বাধার মুখে কাকরাইল মসজিদ মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। গতকাল দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বিজয় নগরে শ্রম ভবনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে যমুনা অভিমুখে যাত্রা করেন তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।
বিকাল ৩টায় মিছিলটি কাকরাইল মসজিদ মোড়ে এলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাতে বাধা দেয়। এরপর থেকে তারা সেখানেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে কাকরাইল মসজিদ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালমুখী রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া মৎস্যভবন থেকে কাকরাইলমুখী সড়কে চলাচলকারী যানবাহনও আংশিক বাধাগ্রস্ত হয়। বিকাল সোয়া ৩টায় বৃষ্টি শুরু হলেও অবস্থান ছাড়েননি পোশাক শ্রমিকরা। বৃষ্টিতে ভিজেই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে দেখা যায়।
সরজমিন দেখা যায়, বেতনের দাবিতে ব্যানার হাতে স্লোগান দিতে দিতে পল্টনের দিক থেকে যমুনার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। কাকরাইল মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা কাকরাইল মোড় অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এর কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় বৃষ্টি।
বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেয়া পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন আশুলিয়ায় অবস্থিত চেইন অ্যাপারেলস লিমিটেড, গাজীপুরে অবস্থিত টিএনজেড গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠান ও ডার্ড গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা।
সাম্য হত্যার বিচারের দাবি, সারা বাংলাদেশ অচল করে দেয়ার হুমকি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা ও শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে সারা বাংলাদেশ অচল করে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব। মঙ্গলবার পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে শাহবাগে অবস্থান গ্রহণ ও “ব্লকেড” করেন ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য প্রদানকালে ছাত্রদল সভাপতি এ হুঁশিয়ারি দেন। বিকাল তিনটায় শাহবাগ ব্লকেড করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এতে আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তারা সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করায় সড়কে তীব্র যানজট ছড়িয়ে পড়ে।
অবস্থান সমাবেশে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমরা কখনো ভয়ে লুকিয়ে যাইনি কখনো পুলিশকে ভয় পাইনি আমরা সেই সংগঠন যারা ভাই হত্যার প্রতিবাদে সব বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে থাকতে পারি। সাম্য হত্যা পরবর্তী অবস্থায় আমরা দেখি ৭ দিন পার হলেও আজ অবধি প্রকৃত খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তারকৃত ওই তিনজন যদি প্রকৃত খুনি হয় তাহলে তাদেরকে রিমান্ডে নিতে বিলম্ব করা হলো কেন? আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি তারা আজও আমাদেরকে নিশ্চিত করতে পারেনি আসল হত্যাকারী কারা। সাম্য হত্যা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, পারভেজ হত্যা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতির পরিণাম এসব হত্যা। যদি আমরা সাম্য হত্যার বিচার না পাই তাহলে সারা ঢাকা অচল করে দেবো, সারা দেশ অচল করে দেবো।
ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ দেয়ার দাবিতে অবস্থান: বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে গতকালও বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তার কর্মী-সমর্থকরা। দক্ষিণ সিটির নগর ভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তার কর্মী-সমর্থকরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকালে বুধবার বিক্ষোভ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে অবস্থান তুলে নেয়া হয়।
গণঅধিকার পরিষদের উত্তর সিটির কার্যালয় ঘেরাও: ওদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে অপসারণ ও গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। অন্যথায় আগামী শনিবার যমুনা ঘেরাও করবে দলটি। মঙ্গলবার ডিএনসিসি ভবনের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে এ কথা বলেন গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, এই সরকারের কাছে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা দিনকে দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সরকারের নানান কর্মকাণ্ড আমাদের অনেক কিছু ভাবায়। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ইতিমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রশাসক হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীদের নেতা মোহাম্মদ এজাজকে নিয়োগ দিয়েছে, যা শহীদদের রক্তের সঙ্গে প্রতারণা। আমরা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছি, নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীদের নেতা মোহাম্মদ এজাজকে অপসারণ করে গ্রেপ্তার না করলে আগামী শনিবার যমুনা ঘেরাও করা হবে।
মানবিক করিডোরের বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, ইন্টেরিম সরকার মানবিক করিডোরের নামে দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে না আসলে আবারো আন্দোলনের দাবানল জ্বলবে। দেশের প্রশ্নে কোনো ছাড় হবে না। আমাদের এক ফোঁটা রক্ত থাকতে মানবিক করিডোর দিতে দেয়া হবে না।
দলটির উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বলেন, মোহাম্মদ এজাজ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীদের নেতা ও এনসিপি’র প্রতিনিধি। নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীদ নেতাকে কারা কতো টাকার বিনিময়ে এই পদে বসিয়েছিল, সেটা তদন্ত করে বের করতে হবে। গণঅধিকার পরিষদ মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিমের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আব্দুজ জারের, শাকিল উজ্জামান, রবিউল হাসান, কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল ইসলাম রতন প্রমুখ।
ড্যাপ সংশোধনের দাবিতে রাজউক ঘেরাও: রাজউকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধনের দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ করেছেন ঢাকার জমির মালিকরা। নতুন ড্যাপে প্লটের ব্যবহার যোগ্যতা হঠাৎ করে কমিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন প্ল্যান পাসে ঘুষ ও জটিলতার বিরুদ্ধে রাজউক ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। ‘ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশন’-এর ব্যানারে মতিঝিল রাজউকের প্রধান কার্যালয় ঘেরাও আয়োজিত কর্মসূচিতে ক্ষুব্ধ ভূমি মালিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন প্রকৌশলী, স্থপতি ও আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা।
কর্মসূচিতে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ বলেন, নতুন ড্যাপের কারণে দুই লক্ষাধিক জমির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রাজউক ঘেরাও অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। রাজউকের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। এই কর্মসূচির কারণে রাজউক কার্যালয় সংলগ্ন এলাকার সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়।
