
হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে আজ সোমবার সকাল সাড়ে আটটার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে একটি মাইক্রোবাসে আদালতে আনা হয়। তাঁকে রাখা হয় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায়।
সকাল ১০টার পর নুসরাত ফারিয়াকে আদালতের কাঠগড়ায় ওঠানোর জন্য হাজতখানা থেকে বের করে আনা হয়। তাঁর মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট। পরেছিলেন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। নারী পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে কড়া পাহারায় নুসরাত ফারিয়া সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠেন। আদালতের কাঠগড়ায় তোলার পর একজন পুলিশ সদস্য তাঁর মাথায় পরানো হেলমেটটি খুলে ফেলেন। তখন সময় সকাল ১০টা ২০ মিনিট।
নুসরাত ফারিয়া দেয়ালের দিকে মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দু–তিন মিনিট তিনি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পরে একজন আইনজীবী নুসরাত ফারিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন নুসরাত ফারিয়া সেই আইনজীবীর সঙ্গে ইশারায় কথা বলেন। তখনই বিচারক সারাহ ফারজানা হক এজলাসে আসেন।আদালতে নুসরাত ফারিয়াকে বিমর্ষ দেখা গেছে। কাঠগড়ায় ৩০ মিনিট রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আদালতে কোনো বক্তব্য দেননি।
ঘটনার সময় নুসরাত দেশে ছিলেন না, বললেন আইনজীবী
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি। ৩ মে ভুক্তভোগী এনামুল বাদী হয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় নুসরাত ফারিয়াকেও তিনি আসামি করেন। মামলাটি ৩ মে এজাহার হিসেবে রেকর্ড হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে নুসরাত ফারিয়াকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। শুনানির শুরুতে নুসরাতের আইনজীবী মোহাম্মদ ইফতেখার হাসান আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার মক্কেল একজন সুপরিচিত অভিনেত্রী। অভিনয় তাঁর পেশা। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। শুধু তা–ই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নুসরাত ফারিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষেও লেখালেখি করেছিলেন, সহমর্মিতাও প্রকাশ করেছিলেন।’
আইনজীবী মোহাম্মদ ইফতেখার হাসান আদালতকে আরও বলেন, যে মামলায় নুসরাত ফারিয়াকে আসামি করা হয়েছে, সে মামলার ঘটনার তারিখ গত বছরের ১৯ জুলাই। বাস্তবতা হচ্ছে, নুসরাত ফারিয়া তখন বিদেশে অবস্থান করছিলেন। নুসরাত ফারিয়া যে ওই সময় বিদেশে অবস্থান করছিলেন, এর সপক্ষে সব প্রমাণপত্র রয়েছে বলে জানান তিনি।
নুসরাত ফারিয়া তখন কানাডায় ছিলেন। পেশাগত কাজ শেষে গত বছরের ১৪ আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন বলে জানান আইনজীবী। আইনজীবী মোহাম্মদ ইফতেখার হাসান নুসরাত ফারিয়ার পাসপোর্ট ও ভিসার কাগজপত্র আদালতের কাছে জমা দেন।

নুসরাত ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম সহযোগী, বললেন পিপি
নুসরাতের আইনজীবীর বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন সিএমএম আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নুসরাত ফারিয়া অভিনেত্রী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী।’
পিপি আরও বলেন, ‘নুসরাত ফারিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বায়োপিকে অভিনয় করেছিলেন। রুপালি পর্দায় তিনি শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয় করা কোনো দোষের কিছু নয়। কিন্তু তিনি পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন, প্রতিটা ঘরে শেখ হাসিনা রয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে খুশি করতে চেয়েছিলেন।’
সংরক্ষিত নারী আসনে নুসরাত ফারিয়া সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন বলেও আদালতের কাছে অভিযোগ করেন পিপি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী হওয়ার কারণে নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পিপি আদালতকে আরও বলেন, ‘আমরা আরও একজন অভিনেতাকে খুঁজছি। তিনি হলেন রুপালি পর্দার নায়ক ফেরদৌস। তিনি ভোট চুরি করে এমপিও হয়েছিলেন। ফ্যাসিস্ট শাসকেরা যেটা করেন, যেসব শিল্পী, যেসব অভিনেতার পরিচিতি আছে, তাঁদের ফ্যাসিস্টরা কাজে লাগান। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাও সেই একই কাজ করেছেন। নুসরাত ফারিয়া, ফেরদৌসদের মতো অভিনেতা, শিল্পীদের কাছে টেনেছিলেন। তাঁরাও ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসন আমল দীর্ঘায়িত করতে সহযোগিতা করেছেন।’
নুসরাত ফারিয়া কেবল ফ্যাসিস্টের সহযোগী নন, তিনি অনলাইনে জুয়ার প্রমোট করছেন বলেও আদালতকে জানান পিপি। বলেন, ‘তিনি একটি জুয়ার অ্যাপসের শুভেচ্ছাদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছেন।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি যখন একের পর এক যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, তখন নুসরাত ফারিয়া ছিলেন বিমর্ষ। তিনি কাঠগড়ায় দুই হাত রেখে পিপির বক্তব্য শুনছিলেন।
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন চলাকালে যখন আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থী, ছাত্র–জনতা আন্দোলন করছিলেন, তখন একদল শিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী তাঁদের শরীরে গরম পানিও ঢেলে দিয়েছিলেন। তাঁরা অনলাইনে গ্রুপ খুলেছিলেন। জুলাই আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।’

২২ মে জামিনের বিষয়ে আদেশ
আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর ২২ মে নুসরাত ফারিয়ার জামিনের বিষয়ে আদেশ হবে বলে জানান। বিচারক এজলাস ছাড়ার পর নুসরাত ফারিয়াকে আবার আদালত থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি
নুসরাত ফারিয়াকে একনজর দেখার জন্য ঢাকার আদালত চত্বরে এসেছিলেন মা ফেরদৌসী বেগম। তিনি সকাল আটটার দিকে আদালত চত্বরে আসেন। অবস্থান করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চত্বরে। পরে তিনি যান হাজতখানার সামনে। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় দেখে তিনি আবার চলে যান জেলা প্রশাসক চত্বরে থাকা একটি কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে।
নুসরাত ফারিয়াকে আদালতে তোলার সময় উপচে পড়া ভিড় দেখে তাঁর মা আর আদালতের সামনে যাননি। বেলা ১১টার দিকে শুনানি শেষ হলে নুসরাত ফারিয়ার মা তাঁর আইনজীবীদের ফোন দেন। আইনজীবীদের কাছ থেকেই নুসরাত ফারিয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার খোঁজখবর নেন মা ফেরদৌসী বেগম। আদালত চত্বরে নুসরাত ফারিয়ার মাকে বিমর্ষ দেখা গেছে। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, নুসরাত ফারিয়াকে আদালত থেকে আবার হাজতখানায় নেওয়া হয়। সেখানে নুসরাত ফারিয়া পানি পান করেন। পরে তাঁকে একটি প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। বেলা ১১টার দিকে প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে কাশিমপুর মহিলা কারাগারের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।