
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি’ করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। তবে দেশের বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘গাজীপুর’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যুক্ত না করে গেজেট প্রকাশ করার প্রতিবাদে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি গেজেট প্রকাশ করার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত টানা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধে কার্যত অচল হয়ে আছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৬ মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত সেশনজটের কবলে পড়ার শঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবিতে এবার ‘লংমার্চ টু ইউজিসি’ কর্মসূচি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ‘লংমার্চ টু ইউজিসি’ কর্মসূচির আওতায় আজ সোমবার (১৯ মে) সকাল আটটায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে তাঁরা পদযাত্রা শুরু করবেন। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কর্মসূচি চলবে।
তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের জন্য চারটি নাম প্রস্তাব করেছেন। এগুলো হলো বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি। এর মধ্যে থেকে যেকোনো একটি নাম নির্ধারণ করার দাবি তাদের। যদিও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এখনো ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি’ নামই দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম সাধারণত দেশের নাম অনুযায়ী হয়ে থাকে। যেমন—বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ। শেষ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও একই অধ্যাদেশের আওতায় পরিবর্তিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাম পরিবর্তনের দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে চিঠি প্রেরণ করেন তারা। তবে কার্যক্রমে কোনো ফল না পেয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি রেলপথ অবরোধ করে নাম পরিবর্তনের দাবি জানান তারা। আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুন আক্তার মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে শিক্ষার্থীরা তিন সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন এবং পরবর্তী তিন সপ্তাহ ক্লাস করেন।
তবে দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঈদের পর গত ৮ এপ্রিল পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ শাটডাউন ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা।
শিক্ষার্থীরা জানান, গত ১৩ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব একটি সভায় বসেন। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘গাজীপুর’ থাকবে না এবং ‘ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি’ নামটিও মৌলিকভাবে ভুল। এটি আওয়ামী লীগের একটি কনসেপ্ট ছিল, এবং এখন সময় এসেছে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার। তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিস’ অথবা ‘আমাদের জুলাইয়ের শহীদদের নামে’ একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনার কথা জানান। একই সঙ্গে তিনি শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম পুনরায় চালুর আহ্বান জানান।
তবে এই আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় ৬ মে ফের প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। পরে ৭ মে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি. আর. আবরার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনকে নিয়ে অনলাইনে একটি মিটিং করেন। সেখানে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ থেকে আসবে। যদিও তিনি শাটডাউন তুলে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাননি।
জানা গেছে, বর্তমানে নাম পরিবর্তনের দাবিতে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উচ্চশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে ঘুরছেন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন প্রতিনিধি। তাঁদের একজন ইন্টারনেট অব থিংস অ্যান্ড রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (IRE) বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফখরুল হাসান ফয়সাল।
তিনি বলেন, ‘তিন মাস পার হয়ে গেলেও একটি ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি এখনো মানা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ প্রশাসনকে বিষয়টি জানানোর পরও এর সমাধান না হওয়ায় আমরা হতাশ। আমাদের যৌক্তিক দাবির ব্যাপারে কোনো ধরনের তালবাহানা চলবে না। আমরা আশা করি, আবার রাজপথে এসে আমাদের দাবির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময়ের মতো আবারও অনুরোধ করছি—আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করুন। শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কাজ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, এবং আমরা সেটিই করতে চাই। কিন্তু আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ কোনোভাবেই এই নতুন বাংলাদেশে মেনে নেওয়া যায় না।’
তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের কাছে বর্তমানে চারটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটির সঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে। এই নামগুলোর যেকোনো একটি দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রাকিব হাসান বলেন, ‘আমাদের সবকিছু চালু আছে। আমরা বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার এখন করছি। আর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে খুব দ্রুত তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং মাস্টার্সের সার্কুলারও খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা সব ম্যানেজ করে নিয়েছি। এখন আর প্রশাসনিক ভবনে তালা নেই। শিক্ষার্থীরা আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। ওয়েবসাইটে নামকরণও গেজেট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষার্থীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে যতদিন যাবে তত তারা সেশনজটে পড়বে। এজন্য সরকারের উচিত বিষয়টি মীমাংসা করে শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাসে ফেরা। কালকে থেকেও যদি তারা ক্লাসে ফেরে সেক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস থেকে দেড় বছর সেশনজড়ে পড়বে বলে তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে একাধিকবার কল দিলেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কারণ নাম পরিবর্তন করা ইউজিসির কাজ নয়। এটা ইউজিসির এখতিয়ারেও পড়ে না। সেখানে যিনি উপাচার্য আছেন, এটা দেখা এবং সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা তার দায়িত্ব।’
শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি অতিরিক্ত কিছু ঘটে, তখন আমরা দেখব। শিক্ষা কার্যক্রম তিন মাস ধরে বন্ধ—এটা আপনি কোথা থেকে জানলেন, আমি জানি না। ছাত্ররা নাম নিয়ে চিন্তা করছে, আর সেটা নিয়ে তিন মাস ধরে কার্যক্রম বন্ধ থাকবে—এটার কোনো যৌক্তিকতা আছে? আপনারা অনুগ্রহ করে ওদের (ছাত্রদের) সঙ্গে কথা বলেন। শুধু নামের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার যৌক্তিকতা আসলে কোথায়, সেটা আপনারাই ভেবে দেখুন।’