
প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ( ইসিএ ) হিসেবে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ , বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় । ১২ মে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয় । বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং অন্যতম বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দূরত্বে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্পকারখানা । পরিবেশবিদ এবং আন্দোলনকর্মীরা বলছেন , অতীতে খোদ সরকার আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইসিএ এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও বনের ১ কিমির মধ্যেই গড়ে উঠেছে গ্রিন টাউন এলপি গ্যাস লিমিটেড । খুলনার দাকোপে পশুর নদের তীরে ।
অনুমোদন দিয়েছিল বলে তাঁরা নতুন ঘোষণার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না । সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বনসংলগ্ন শিল্পকারখানাগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে বেশি দূষণকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বলছেন তাঁরা ।
১৯৯৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ( ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ ) ঘোষণা করে । এ এলাকার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলা , বাগেরহাট জেলার মোংলা , মোরেলগঞ্জ , রামপাল ও শরণখোলা উপজেলা , খুলনা জেলার দাকোপ , কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা , বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা এবং পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা । এসব স্থানে কলকারখানাসহ যেকোনো নির্মাণকাজ করার আগে বন ও বনের প্রাণীদের মোংলাতেই বনঘেষা ৬৬ শিল্প সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নানা রকম শর্ত আরোপ করা হয় ।
ইসিএ ঘোষণার পরও সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় শিল্পায়ন ও স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকে । ইসিএ ঘোষণার আগেই সেখানে ১৮৬ টি শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়েছিল । ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট সরকারের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ জাতীয় পরিবেশ কমিটি সুন্দরবন ঘেঁষে গড়ে ওঠা মোট ৩২০ টি শিল্পকারখানাকে কার্যক্রম পরিচালনার নীতিগত অনুমোদন দেয় । এর মধ্যে ছিল আগের ১৮৬ টি , নতুন করে স্থাপিত ১১৮ টি শিল্পকারখানা ও প্রকল্প এবং অনুমতির আবেদন করা ১৬ টি প্রতিষ্ঠান । সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায় , মোংলা উপজেলার মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল , মোংলা বন্দরের শিল্পাঞ্চল ও এর সংলগ্ন এলাকা এবং মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ( ইপিজেড ) সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত ।
সরকারি নতুন নিষেধাজ্ঞার পাঁচ দিন আগে ৭ মে মোংলা বন্দর শিল্পাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায় , সিমেন্ট কারখানা , এলপিজি প্ল্যান্ট , তেল শোধনাগারসহ ২৩ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে । এর মধ্যে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোর সিমেন্ট কারখানা রয়েছে ৫ টি আর এলপিজি প্ল্যান্ট রয়েছে ৫ টি । এ প্রতিষ্ঠানগুলো মোংলা বন্দরের কাছ থেকে প্লট ইজারা নিয়েছে । মোংলা বন্দরের শিল্পাঞ্চলের বাইরে ৭ টি এলপিজি প্ল্যান্টসহ আরও ৯ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে । এর মধ্যে পশুর নদের তীরের গ্রিন টাউন এলপিডি প্ল্যান্টটির অবস্থান সুন্দরবনের মাত্র ১ কিলোমিটারের মধ্যে । ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মোংলা ইপিজেডের ২৭৮ টি প্লটের অধিকাংশই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে । এখানে ৩৪ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনকাজ শুরু করেছে ।
মোংলা ইপিজেডের বর্তমানে চালু প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সোয়েটার , চুরুট , রাবার , পরচুলা , টাওয়েল , পলি ব্যাগ ও প্রিন্টিং জুট , তৈরি পোশাক , স্টিলের টিউব , বলপেন , টুথব্রাশসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারখানা । মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ হওয়া ২০৫ একর জায়গায় এখনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি । সুন্দরবনের কিলোমিটার সীমানার মধ্যেই মোংলা উপজেলার জয়মনির ঘোল গ্রাম । এই গ্রামে খাদ্য অধিদপ্তর নির্মাণ করেছে একটি সাইলো বা বড় খাদ্যগুদাম । জাহাজ নির্মাণ কারখানা করার জন্য এই গ্রামেই প্রায় ২০০ একর জমি কিনেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ । তবে তিনি পরিবেশ ছাড়পত্র নিলেও কারখানাটি স্থাপন করেননি ।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘ সুন্দরবন রক্ষায় আমরা'র সমন্বয়কারী মো . নূর আলম শেখ বলেন , “ পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে , আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই । তবে এ উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে , সে ব্যাপারে আমরা চিন্তিত । কারণ বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি , সরকারই উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইসিএ এলাকার মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে । ' নূর আলম শেখ উল্লেখ করেন , সিমেন্ট ও এলপিজি প্ল্যান্ট দূষণের মাত্রার বিচারে পরিবেশ অধিদপ্তরের লাল ক্যাটাগরির ( অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ) অন্তর্ভুক্ত । এসব কারখানার দূষণের প্রভাবে সুন্দরবনসংলগ্ন নদী - খালে মাছের প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে । পশুর নদের ইলিশ মাছের
আকার ক্রমেই ছোট হচ্ছে । এ ছাড়া সুন্দরবনের জলজ প্রাণিকুলও ক্ষতির সম্মুখীন । সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন ' - এর চেয়ারম্যান ড . ফরিদুল ইসলাম ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেছিলেন । সেই রিটে পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন শিল্পকারখানার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত । ফরিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিগত সরকারের আম ে কয়েকটি এলপিজি প্ল্যান্টসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল । আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই , সুন্দরবনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে এমন কোনো শিল্প ইসিএ এলাকার মধ্যে করা যাবে না । যেগুলো ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়ে গিয়েছে , সেগুলো নতুন করে নজরদারির আওতায় আনতে হবে । পরিবেশবান্ধব শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে তাতে আমাদের আপত্তি নেই । '
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ যেসব শিল্পকারখানা লাল ক্যাটাগরির , সেগুলো তিন ধরনের দূষণ তৈরি করে । প্রথমত , তারা বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে । দ্বিতীয়ত , সিমেন্ট কারখানার ছাই বাতাসে উড়ে লোকালয় ও বনের মধ্যে ছড়ায় । তৃতীয়ত , কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদী- খালের পানিতে ফেলা হয় । পানিতে মেশা বর্জ্য জোয়ার - ভাটার কারণে সুন্দরবনের মাটিতে ঠাঁই নেয় । এভাবে দূষণ মাটি , পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে যায় । ’ আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী আরও বলেন , পানিতে রাসায়নিক বর্জ্য মেশার কারণে জলজ প্রাণীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে । শুশুকসহ জলজ প্রাণীদের প্রজননক্ষমতা কমে যাচ্ছে । মাছের সংখ্যাও কমে এসেছে । মাটিতে বীজ থেকে চারা গজানোর হারও আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে । ধীরে ধীরে ঘটছে বলে খালি চোখে আমরা হয়তো এই ক্ষতির মাত্রা ধরতে পারি না । তবে ক্রমাগতভাবে এই দূষণ বন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে । সুন্দরবনের নদী - খালের দুষিত মাছ খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে ।
শিল্পকারখানাগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা দূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে । সুন্দরবনবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলেন , যেসব কারখানা পরিবেশ , জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জন্যে গুরুতর ক্ষতির কারণ সেগুলো পরীক্ষা করে অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত । আর যেগুলোতে বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া । এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আসাদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি । আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ( বেজা ) বলেছেন , ‘ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ইসিএ এলাকায় নতুন কোনো শিল্পকারখানা বা প্রকল্প নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে । বেজা ইতিমধ্যে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিকে ( পরিবেশ অনুকূল শিল্প ) প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করেছে । সরকার ভিন্ন যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে বেজা অবশ্যই সে সিদ্ধান্ত বিবেচনা - পর্যালোচনায় নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনা সংশোধন- পরিবর্তন - পরিবর্ধন করবে । '