
আসছে বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে। এতে কিছুটা স্বস্তি পাবেন সাধারণ করদাতারা। অন্যদিকে আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে ধনীদের। আর ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতের করছাড় তুলে দেওয়া হতে পারে। এসব খাতের কর সুবিধার অপব্যবহার করে অনেকে কর ফাঁকি দিতেন বলে আগামী দিনে এসব খাতের করছাড় তুলে দেওয়া হতে পারে। এসব পরিবর্তন আসতে পারে আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এনবিআরের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে বিষয়গুলো চূড়ান্ত হবে। আজ বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বাজেটে এর বাইরেও আরো কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। এর মধ্যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে করপোরেট করের হার ঠিক রেখে শিথিল হতে পারে শর্ত। তবে দ্বিগুণ হতে পারে টার্নওভার কর। বাড়ি ও ফ্ল্যাট কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও দিতে হতে পারে বেশি কর।প্রধান উপদেষ্টা এসব প্রস্তাবে সায় দিলে আসছে বাজেটে তা কার্যকর হবে।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে
দেশে বর্তমান কর কাঠামো অনুযায়ী, সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। পরবর্তী এক লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। তবে আগামী বাজেটে প্রতিটি স্লাবে ২৫ হাজার টাকা করে বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত থাকবে।
সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ
বর্তমানে আয়কর ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ। তবে গত কয়েক বছরের বাজেটে ধনীদের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ কর আদায়ের কথা ভেবেছিল এনবিআর। অদৃশ্য কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এবার তা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ হলেও এটিকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে।
ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকাভেদে ব্যক্তির ন্যূনতম কর একেক রকম। বর্তমানে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ন্যূনতম করের পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা। অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় এই করের পরিমাণ চার হাজার টাকা। আর সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় ব্যক্তির ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা। তবে আগামী বাজেটে বিভিন্ন এলাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের করের হার ব্যবস্থা উঠে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সারা দেশের সব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ন্যূনতম কর হতে পারে পাঁচ হাজার টাকা।
ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতে কর ছাড় বাতিল
ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতের সর্বোচ্চ করহার ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ। করহারে বড় পার্থক্য থাকায় কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে সমাজের অনেক রাঘববোয়ালই নিজেকে মৎস্য খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে দাবি করে কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন। এবার এই কর ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। কর ফাঁকি ও কালো টাকা সাদা করার সহজ এই কৌশল রুখে দিতে এই খাতে আয় করলে তাতে বাড়তি কোনো কর সুবিধা দেওয়া হবে না। স্বাভাবিক হারেই দিতে হবে আয়কর।
তথ্য বলছে, এসব খাতের আয়ের প্রথম ১০ লাখ টাকা করমুক্ত। পরের ১০ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ। তার পরের ১০ লাখের ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা আছে। আর আয় ৩০ লাখ টাকার বেশি হলে সেখানে সর্বোচ্চ করহার ১৫ শতাংশ।
বেশি কর দিয়ে কালো টাকা সাদার সুযোগ থাকছেই
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রণীত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো ব্যক্তি বা কম্পানি তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সাদা করার সুযোগ পেয়েছেন। একই করহারে সাদা করা গেছে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সর্ব প্রকারের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট। এসব পরিসম্পদ অর্জনের উৎসর বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগও রাখা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এই সুবিধা বাতিল করে।
তবে বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সুযোগ এবারও বহাল থাকছে। বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য বিভিন্ন এলাকার মৌজাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসের করহার সর্বনিম্ন প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা। একই সঙ্গে ভূমির করহার বিভিন্ন এলাকার মৌজাভেদে প্রতি বর্গমিটারে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এই সুযোগ বহাল রাখা হলেও এতে করের পরিমাণ অনেক বাড়ানো হবে। ফলে কেউ আর এতে উৎসাহিত হবেন না।
ব্যবসায় টার্নওভার কর বেড়ে দ্বিগুণ
সহজপথে কর আদায়ের কৌশল হিসেবে টার্নওভার কর বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হতে পারে। ব্যবসায় লোকসান করলেও এই কর দিতে হয়। বর্তমানে যেসব ব্যবসায় বছরে তিন কোটি টাকা বা এর বেশি টার্নওভার রয়েছে, তার ওপর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হয়। তবে পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম তিন বছর ন্যূনতম করহার দশমিক ১০ শতাংশ। এর বাইরে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি-নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ, তামাক প্রস্তুতকারক সিগারেট কম্পানির ন্যূনতম করহার ৩ শতাংশ এবং কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদকদের করহার ৩ শতাংশ।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে ন্যূনতম করহার দশমিক ৬০ থেকে বাড়িয়ে এক শতাংশ করা হচ্ছে। তবে মোবাইল অপারেটর ও সিগারেট, বিড়ি, চুষে খাওয়ার তামাক, ধোঁয়াবিহীন তামাক বা অন্য সব তামাক প্রস্তুতকারক কম্পানির ন্যূনতম কর আগের মতোই থাকছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক লেনদেনের ওপর টার্নওভার কর বা ন্যূনতম কর আরোপ করা হয়েছিল। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি-নির্বিশেষে এই কর আদায় করা হয়। ব্যবসায় লোকসান হলেও এই কর ব্যবসায়ীদের দিতে হয়। ন্যূনতম করকে আয়কর আইনের মূলনীতির পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে।
করপোরেট করের শর্ত শিথিল
করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা পেতে নগদ লেনদেনের শর্ত শিথিল করা হতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে শর্তজুড়ে দিয়ে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়। শর্ত দেওয়া হয়, এ সুযোগ নিতে হলে কম্পানিগুলোকে অবশ্যই সব ধরনের প্রাপ্তি ও আয় ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের সীমা বছরে ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে এই সীমা বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা এবং একক লেনদেনের সীমা পাঁচ লাখ টাকা করা হয়। গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে ধারাবাহিকভাবে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেট কর ছিল ৩৫ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশ, ২০২১-২২-এ ৩০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর ২৭.৫ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে করহার ২৫ শতাংশ করা হয়।
ফিরতে পারে অ্যাসেসমেন্টের বিধান
করদাতার হয়রানি কমাতে গত অর্থবছর আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হয়েছিল। এ জন্য বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল আয়কর আইনে। ব্যক্তি ও কম্পানি—দুই শ্রেণির করদাতাদের স্বস্তি দিতে এ সিদ্ধান্ত নিলেও এতে কর আদায়ে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অ্যাসেসমেন্টের বিধান ফিরতে পারে।