
ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে মরে যাচ্ছে পদ্মা নদী। মরুময়তা গ্রাস করছে উত্তরাঞ্চলকে। দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। এতে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছেন নদী অববাহিকার জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও পাবনার লাখ লাখ মানুষ। এমন অবস্থায় ভারত থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আরো কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।
এ পরিণতির শঙ্কা থেকেই ৫০ বছর আগে ১৬ মে বাঁধ বন্ধে কানসাট অভিমুখে লংমার্চ করেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জবাবে ভারত ১৯৫২ সালে জানায়, গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই রয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত প্রথম এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসে। এ প্রক্রিয়া চলা অবস্থায়ই ১৯৬১ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগেই ১৯৭০ সালে ফিডার খাল ব্যতীত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করে ফেলে ভারত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এ বাঁধটি অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ ২ হাজার ২৪০ মিটার লম্বা। প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় এ বাঁধ নির্মাণ করে ভারত।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ চালুর উদ্যোগ নেয়। প্রথমে ফিডার ক্যানেলে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক চালুর কথা বলে মাত্র ৪১ দিনের জন্য (১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়। সেই পরীক্ষামূলক প্রত্যাহারই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ঢুকে পদ্মা নাম ধারণ করে। এই নদীকে কেন্দ্র করেই এক সময় আবর্তিত হতো এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে সময়ের ব্যবধানে এই নদী এখন এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কারণ। বাঁধ নির্মাণের পর বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। আবার বর্ষা মৌসুমে ছেড়ে দেওয়া পানিতে একদিকে যেমন নদীগর্ভে বিলীন হয় গ্রামের পর গ্রাম, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল পরিণত হয় ধু-ধু বালু চরে। নদী পানিশূন্য হওয়ায় কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন নদী পাড়ের মানুষ। বিরূপ আবহাওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে তাপমাত্রা, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে এ অঞ্চল।
শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা একবর আলী জানান, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে নদী পানিশূন্য থাকে। এ সময় মাইলের পর মাইল বালুর চর জেগে ওঠে। ফলে তাপমাত্রা প্রতি বছরই বাড়ছে। যা সহ্য করা এখন আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও।
একই এলাকার বাসিন্দা শাহিন সরওয়ার বলেন, আগে পদ্মা নদীতে মাছ মেরে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করেছি। বর্তমানে নদীতে পানি নেই; তাই আর মাছও পাওয়া যায় না। এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে আছি। আর আমাদের জেলেদের এ সমস্যার জন্য দায়ী ফারাক্কা বাঁধ।
পদ্মা নদীতে মাছ ধরার সময় কথা হয় পাঁকা ইউনিয়নের বোগলাউড়ির জেলে আসমাউলের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় এ নদীতে হাজার হাজার জেলে মাছ ধরত। মাছ মেরেই সবাই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন আর সেটা না হওয়ায় এ অঞ্চলের বহু জেলেই অন্য পেশায় চলে গেছে। আমরা যারা এখন মাছ মারছি তাতে কোনোদিন দিনমজুরির পয়সা হয় কোনোদিন হয় না। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের জেলেরা খুব বিপদে আছি।
শিবগঞ্জ উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক তসলিম উদ্দিন বলেন, ইন্দিরা গান্ধী যে সময় থেকে এই মরণ বাঁধ উদ্বোধন করলেন তখন থেকেই আমাদের দুঃখ দিন দিন বাড়ছেই। এ বাঁধ ভারত সরকার তৈরি করার পর থেকে পদ্মার ভাঙনে বেশ কয়েকবার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, দুর্লভপুর, পাঁকা, উজিরপুর, সুন্দরপুর, চরবাগডাঙ্গা, আলাতুলি, দেবিনগর, শাজাহানপুর, ইসলামপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশিরভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ফলে ভিটেবাড়ি হারিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে পথে বসতে হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব বলেন, গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি দেওয়ার কথা গত ২৫ বছরের বেশিরভাগ সময়ে সেই পরিমাণ পানি দেয়নি ভারত। ভূমি ও পানি সমতলের সর্বনিম্ন স্তরের যে ব্যবধান সেটা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বৃদ্ধির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীর পাড়ের যে স্থিতিশীলতা তা হ্রাস পাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতি বছরই নদী ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছেই। পানির যে প্রবাহ সেটার সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সরাসরি সর্ম্পক রয়েছে। গত ২৫ বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ার কারণে তাপমাত্রা মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ওঠানামা করছে এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
সম্প্রতি পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ পরিদর্শনে আসা একদল গবেষকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে হওয়া লং মার্চ যথার্থ ছিল। সেইদিন অনেক রাজনীতিবিদই তাকে ঠাট্টা করেছিলেন। কিন্তু, সেই লং মার্চের ৪৯ বছর পর আজ আমরা কী দেখছি? দেখছি, দিন দিন কমছে পদ্মার পানি। ফারাক্কার প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ফারাক্কা বাঁধের সুষম পানি বণ্টনের যে চুক্তি হয়েছিল, তা ভারত না মানায় আজকের এই পরিণতি। তাই অনতিবিলম্বে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্যহিস্যা বুঝে নেওয়া হোক। আর ফারাক্কার কুপ্রভাবে আমরা যে মরুভূমিতে পরিণতি হচ্ছি তা দূর করতে একটা পদক্ষেপ নেওয়া হোক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। প্রয়োজনে এই বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হোক সরকার।