
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাদের আত্মীয়স্বজন, আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী, আমলা-যে যেভাবে পেরেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছে। ঘুস-দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালানসহ অবৈধ উপায়ে কামানো এসব টাকা পাচারে বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হচ্ছে অবৈধ হুন্ডি। পাচারের অন্যতম মাধ্যমও বলা হচ্ছে হুন্ডিকে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও এর চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে। হুন্ডির কারবারিরা এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে। তাদের মূল টার্গেট থাকে প্রবাসীদের আয়। চক্রগুলো দেশে-বিদেশে বিছিয়েছে হুন্ডির জাল। অনেক প্রবাসী না বুঝেই জড়িয়ে পড়ছেন এ চক্রের জালে। আবার অনেকে প্রবাসে নানা জটিলতায় পড়ে নিরুপায় হয়ে অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি এসব চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে। মোটা অঙ্কের কমিশনের লোভে এ চক্রে জড়িয়েছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মের এজেন্টরাও।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, এমএফএস এজেন্টদের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে বেআইনি হুন্ডি কারবার চলছে। এছাড়া মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কোনো প্রমাণ থাকছে না। ফলে আইনের আওতায় আসছে খুব কম অপরাধী।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মো. ছিবগাত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। যারা পাচার করেছে, তাদের শনাক্ত করা এবং টাকা ফেরত আনতে আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী দিনে যেন কেউ টাকা পাচার করতে না পারে, সে বিষয়ে কাজ করছি।’
যেভাবে হুন্ডির মাধ্যমে আসে প্রবাসীর টাকা : গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হুন্ডি চক্রের প্রবাসে অবস্থানকারীরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রা ও তার স্বজনদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব নম্বর সংগ্রহ করে। পরে অ্যাপের মাধ্যমে চক্রের বাংলাদেশে অবস্থানকারীদের কাছে সেই হিসাব নম্বর পাঠানো হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে প্রবাসীদের স্বজনদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাবে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশ থেকে যে টাকা স্বজনদের কাছে পাঠানো হচ্ছে, সেই টাকা চক্রের কাছে দেন অবৈধ টাকার মালিকরা বা হুন্ডির নেপথ্যের সুবিধাবাধী ব্যক্তি। এভাবে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিরাপদে হুন্ডির মাধ্যমে দুবাই, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীদের আয় দেশে আসছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোন বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। উলটো পাচার হচ্ছে।
সূত্র বলছে, ঢাকার সাভারের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন সৌদি আরব থাকেন। প্রবাসে নানা জটিলতার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান তিনি। তার আকামা সংক্রান্ত জটিলতার জন্য বৈধপথে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। ফলে হুন্ডি কারবারিদের একটি চক্রের মাধ্যমে দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠান।
এমন বেশকিছু টাকা ওই প্রবাসীর ভগিনীপতির বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। বিষয়টি ধরা পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে।
প্রবাসীর ওই ভগিনীপতি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বোনজামাইয়ের পাসপোর্ট ও আকামার নামের মধ্যে কিছুটা অমিল থাকায় ছয় মাস বৈধভাবে দেশে টাকা পাঠাতে পারেনি। তখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন।
এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন কুষ্টিয়ার এক প্রবাসী। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব থাকেন। তার আকামা সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে।
এমন ৫০টি ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সিআইডি। যারা প্রতিনিয়ত হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুন্ডি কারবারে জড়িতদের বড় অংশই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। তারা অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়েও টাকা পৌঁছে দিচ্ছেন। অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, দুটি মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হুন্ডির কারবার বেশি পরিচালিত হচ্ছে। স্বল্পসময়ে বিপুল অর্থ কামানোর লোভে এসব মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরাও জড়িয়ে পড়েছে হুন্ডি কারবারিদের চক্রে। এসব এজেন্টকে খুঁজে বের করাও কষ্টসাধ্য। এখন পর্যন্ত হুন্ডির অর্থ লেনদেনকারী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের শতাধিক এজেন্ট গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানও হুন্ডি কারবারারে জড়িত। হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই কারও কাছে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংকট নিয়ে কাজ করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকার বেশি।
ইতোমধ্যে দুবাই, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে সাবকে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে। তার খালাতো ভাই মো. মামুন সালাম ও মামুনের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাসহ আটজনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, দুই কোটির বেশি বাংলাদেশি দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন কাজে যুক্ত। পরিবার দেশে থাকার কারণে এসব প্রবাসীকে প্রতিমাসে দেশে টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু যে সংখ্যক প্রবাসী বিভিন্ন দেশে আছেন, সে পরিমাণ টাকা দেশে আসছে না। মূলত টাকা এলেও সেটি হিসাবের খাতায় না থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হুন্ডি।
দেশের টাকা কী পরিমাণ হুন্ডিতে পাচার হয়, এ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বলছেন, দেশের ৫১ শতাংশ টাকা বৈধ চ্যানেলে এলেও বাকি ৪৯ শতাংশ টাকা লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
হুন্ডির কারবারিদের মূল টার্গেট থাকে সৌদিতে থাকা প্রবাসীদের আয়ের ওপর। সেখানে থাকা অনেকেরই আকামা বা কাজের বৈধ অনুমতিপত্র থাকে না। ফলে বাইরে বের হলে গ্রেফতারের ভয়ে থাকেন তারা। ব্যাংকের মাধ্যমেও টাকা পাঠাতে পারেন না। এ কারণে হুন্ডির কারবারিরা ওই প্রবাসীর কাছে গিয়ে দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এছাড়া ব্যাংকের অবস্থান কর্মস্থল থেকে দূরে হওয়ায় দেশে টাকা পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলেও অনেকে প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যমে সহজেই টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রবাসীরা দেশ থেকে যখন সৌদি আরব যাচ্ছেন, তখনই তারা কত টাকা দেশে পাঠাতে পারবেন তার লিমিট নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু অনেকে গোপনে অন্যান্য কাজ করে অতিরিক্ত অর্থ আয় করেন। সেই টাকা বৈধ পথে পাঠাতে পারেন না। সেগুলো হুন্ডিতে পাঠানো হচ্ছে।