Image description
প্রি-ফ্লাইট ইন্সপেকশন নিয়ে সন্দেহ

কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ড্যাশ-৮ ৪০০ মডেলের এয়ারক্রাফটের চাকা খুলে যাওয়ার ঘটনায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটিতে এমন ঘটনা ঘটতে পারে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রেও মানুষের অবহেলা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এয়ারক্রাফটি প্রচলিত মান মেনে প্রকৌশল বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল কি না? পাশাপাশি উড্ডয়নের আগে নিয়ম অনুযায়ী প্রি-ফ্লাইট ইন্সপেকশন হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তা হয়ে থাকলেও দায়িত্বরত প্রকৌশলী ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেননি বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত শুক্রবার দুপুরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি ৪৩৬ ফ্লাইটটি উড্ডয়নের পর পেছনের বাঁ পাশের একটি চাকা খুলে পড়ে যায়। পরে ফ্লাইটটি ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপদে জরুরি অবতরণ করে। ফ্লাইটটিতে পাইলট, ফার্স্ট অফিসার, দুই কেবিন ক্রু ছাড়াও ৭১ যাত্রী ছিলেন।

এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য বিমানের প্রকৌশল শাখাকে দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ফ্লাইট অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৌশল শাখার কর্মীরা পুরো এয়ারক্রাফট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ফ্লাইট উড্ডয়নের আগেও প্রতিটি চাকার নাট-বোল্ট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় ইন্সপেকশন করে লগ বইতে ‘এয়ারক্রাফট ফিট ফর ফ্লাই’ লিখতে হয়। প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর করা লগ বই দেখার পর ওই ফ্লাইটের পাইলটও একইভাবে পুরো সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। এরপরই ল্যান্ডিং গিয়ারের লক খোলার অনুমতি দেন পাইলট; কিন্তু কক্সবাজারের ফ্লাইটটির ক্ষেত্রে নিশ্চয় এর ব্যত্যয় ঘটেছে, না হলে এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক কারণেই চাকা বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তবে খুব কাছাকাছি সময়ে সেটি পরিবর্তন করলে এবং সেক্ষেত্রে নাটগুলো ভালোভাবে টাইট দেওয়া হয়েছিল কী না, সেই প্রশ্ন থাকতে পারে। চাকার নাট স্থাপনের পর একটি সেপটিক পিন থাকে, সেটি ঠিকমতো বসানো হয়েছিল কি না বা মিস হয়েছিল কি না, নাকি উল্টো করে বসানো হয়েছিল—এসব বিষয়ও ভেবে দেখা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘চাকাগুলো অনেক স্পিডে ঘোরে। উড্ডয়ন বা অবতরণের সময়ে যদি সামান্য ঢিলেঢালাও থাকে, তাহলে সেটি আস্তে আস্তে ছুটে যেতেই পারে। কিন্তু যান্ত্রিক কারণে এমনটি হলেও প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে প্রকৌশলীরা কি দীর্ঘদিন ধরে তা লক্ষ্য করেননি? হয়তো সংশ্লিষ্টরা এটা কেউ লক্ষ্য করেননি বা বা ওভারলুক করেছেন।’

প্রতিটি ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে প্রাক-ফ্লাইট ইন্সপেকশন করা হয় জানিয়ে এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘একজন ইঞ্জিনিয়ার তা করেন। এখানে গাফিলতি ছিল কি-না, সে প্রশ্ন তো থাকেই। তা ছাড়া এই নাট-বোল্ট বা চাকা, এগুলো এক ধরনের মেটেরিয়াল। এগুলো ফেইল করতে পারে, ভেঙে যেতে পারে। তবে সঠিক তদন্ত করে পরবর্তীতে এই ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব।’

একটি চাকা ছাড়া ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণের পর পাইলটের দায়িত্বশীল ও দক্ষতার প্রশংসা করছেন যাত্রী ও এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা। বিমানের একজন পাইলট কালবেলাকে বলেছেন, পাইলট ঠিকঠাক তার দায়িত্ব পালন করায় এত প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। তবে উড্ডয়নের আগে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।

বেসরকারি এয়ারলাইন্স ফ্লাই ঢাকার পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন্স) ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, সাধারণত যান্ত্রিক দুর্বলতা, ভুল রক্ষণাবেক্ষণ, চাকার লকিং বা ফিটিংয়ের ত্রুটি, অতিরিক্ত চাপ বা কাঁপুনির ফলে বিচ্ছিন্নতা এবং সঠিক মাপে চাকার নাট শক্ত না করার কারণে কোনো চাকা খুলে যেতে পারে।

তিনি বলেন, সাধারণত বিমানের একটি চাকায় নাট স্থাপনের পর সেখানে পিন স্থাপন করা হয়। সেটি সঠিকভাবে স্থাপন না করলে বা নাটে টর্টিং কম হলে সেটি খুলে পড়তে পারে বা বেশি হলে ভেঙে যেতে পারে। এতে চাকা খুলে যায়। আর এসব ঘটে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ২০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করা এই পাইলট বলেন, এ ধরনের ঘটনার পরে এয়ারক্র্যাফটের ব্ল্যাকবক্স, মেইনটেন্যান্স রেকর্ড এবং যান্ত্রিক অংশ পরীক্ষা করা হয়। নিশ্চয় তদন্তে বিমানের ঘটনাটি বেরিয়ে আসবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ)Ñএ বি এম রওশন কবীর কালবেলাকে বলেন, চাকা খুলে যাওয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে চিফ অব সেফটি ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদারকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঘটনা জানা যাবে।