
আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে কাগজে-কলমে না হলেও কার্যত নিষিদ্ধ ছিল দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম।
দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করাকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সমর্থন করেছে এবং এতে তারা ‘আনন্দিত’ বলেও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন দল হয়ে বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলছেন ভিন্ন কথা।
সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। তবে তার দল বিএনপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে যে অবস্থান নিয়েছে, সেটিকে তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় ভবিষ্যতে দেশে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে, এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি দলের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।’
বিবিসি বাংলার ওই সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে ফজলুর রহমান এখন ‘ভাইরাল’ (আলোচিত)। এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বলছেন, ফজলুর রহমান বিএনপির নেতা হলেও আওয়ামী লীগের প্রতি তিনি ‘উদার’। রাজনীতিবিদদের অন্য দলের প্রতি এমন ‘উদারতা’র নজির দেশে খুব কম।
অনেকে বলছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান প্রথম জীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। একপর্যায়ে দলটিকে ছেড়ে তিনি অন্য দল হয়ে বিএনপিতে যোগ দিলেও ‘সাবেক দলের প্রতি মায়া ছাড়তে পারেননি’। অনেকের প্রশ্ন, তিনি কি বিএনপির ‘আওয়ামী লীগ বিষয়ক সম্পাদক’?
সুখবর ডটকম খোঁজ নিলে জানতে পারে, গত বছরের অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ বক্তব্য দিয়ে কয়েকবার ভাইরাল (আলোচিত) হয়েছেন ফজলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে তার বক্তব্যও সাড়া ফেলে অনেকের মধ্যে।
ফজলুর রহমান একসময় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ থেকে যোগ দিয়েছিলেন কাদের সিদ্দিকীর গড়া ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ’ দলে। সেখানেও সুবিধা করতে পারেননি। পরে যোগ দেন বিএনপিতে। ১৯৯১ সালের পর তিনটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন তিনি।
চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও পরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি কাদের সিদ্দিকীর দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই দলের প্রার্থী হিসেবে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কোনো দল নিষিদ্ধ করলে সেই দল শেষ হয়ে যায়, এইটার কোনো প্রমাণ এই পৃথিবীতে নাই।’
বাংলাদেশ সামনে মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি এই দুইভাগে বিভক্ত হতে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত তিনি দেখছেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বাইরেও কোটি কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রয়েছেন, সেই রাজনীতি থাকবে।’
যোগাযোগ করলে তিনি সুখবরকে বলেন, ‘আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ থাকবে। কারণ, এ দেশের ৯৯ শতাংশ হলেন বাঙালি জাতিসত্তার মানুষ। শুধু পাহাড়ি ১ শতাংশ লোক বাদ দিলে সব মানুষ বাঙালি। বাঙালির একটা রাজনীতি থাকবে। সেই বাঙালির রাজনীতিই হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি, যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ও বিকশিত।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনো ব্যক্তি না, এখানে শেখ হাসিনা না, অন্য কেউ না। আওয়ামী লীগ স্বতঃসিদ্ধ, মাঠি ফুটে ওঠার মতো বাঙালি জাতিসত্ত্বার একটি রাজনৈতিক দল। আজকে বিপদে আছে, কালকে থাকবে না। ঝড় এলে বটগাছ নিচু করে দেয়, অনেক বটগাছের মাথা ভেঙে যায়, কিন্তু বটগাছ শেষ হয়ে যায়, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সেভাবেই ফিরে আসবে, তার চিন্তা চেতনা ও নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচার হোক।’