Image description

স্বৈরাচার পতনের দিন ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালায়। এ সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়। পুলিশ জানায়, ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮২৬ রাউন্ড গোলাবারুদ লুট হয়েছে।

এর মধ্যে এখনো ১ হাজার ৩৭৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৫১ হাজার ৮২৬ গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা এসব ব্যবহার করে দেশে ত্রাস সৃষ্টি করছে। খুন, ছিনতাইয়েও ব্যবহার হচ্ছে এসব অস্ত্র ও গুলি। তবে সেগুলো উদ্ধারে কচ্ছপগতিতে চলছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন-ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়া আসামিদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, সেগুলো পাঁচ আগস্ট খোয়া যাওয়া অস্ত্র। গত ২৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় অরিন ও হুদা নামে দুজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের থেকে ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, ওই গুলিগুলো জুলাই বিপ্লবের সময় খোয়া গিয়েছিল।

গত ৩ এপ্রিল খুলনা নগরে পুলিশের লুণ্ঠিত শটগান ও কার্তুজসহ তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৫ নভেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের অভিযানে সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী এলাকা থেকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ উদ্ধার এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া শটগান ও গুলি পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র। পুলিশ জানিয়েছে, লুট হওয়া অস্ত্রে পুলিশ বাহিনীর সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে। এতে অস্ত্রগুলো সহজেই চিহ্নিত করা যায়। সেই অস্ত্রগুলো দুর্বৃত্তরা রঙ করে অথবা সাংকেতিক চিহ্ন বদল করতে পারে। এতে পুলিশ ওই অস্ত্র উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে।

সূত্র জানায়, খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে বিলম্বের কারণ হচ্ছে, পুলিশের বদলি প্রভাব। গত ১৭ বছর ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যারা কর্মরত ছিলেন তারা সবাই বদলি হয়ে গেছেন। এতে অস্ত্রগুলো কার হাতে যেতে পারে তা তারা বুঝতে পারছেন না। এছাড়া ঢাকায় নতুন আসা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই রাস্তাঘাট ও অলিগলি চিনতে পারছেন না। এতে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত না করার কারণে অস্ত্রগুলো উদ্ধার হচ্ছে না।

এ বিষয়ে আইজিপি বাহারুল আলম আমার দেশকে জানান, ‘খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব অস্ত্র বিগত আন্দোলনে হারিয়ে গেছে বা লুট হয়েছে সেগুলো দ্রুতই উদ্ধার জরুরি। নইলে আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশে ৪৭২টি থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি থানা-ফাঁড়িতে। ঢাকায় ৪৮টি থানায় আগুন দেওয়া হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা থানা, পুলিশ ফাঁড়িসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। উদ্ধার না হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ২৯৬টি চায়না রাইফেল, ৮টি বিডি রাইফেল, চায়না এসএমজি ৬০টি, এলএমজি ১১টি, চায়না পিস্তল ৫৪টি, ৯ বোরের পিস্তল ৬৫৩টি, এসএমজি একটি, ১২ বোরের শটগান ৬৫৩টি, সিঙ্গেল গ্যাস গান ১১৭টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ৫টি ও সিগন্যাল পিস্তল ২টি।

সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর গণভবন থেকে এসএসএফের ৩২টি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও খোয়া যায়। এসএসএফের সদস্যরা জীবন বাঁচাতে ওই অস্ত্রগুলো সেখানে ফেলে দিয়ে দেয়াল টপকে চলে যান। খোয়া যাওয়া এসএসএফের এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল।

পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছিল। সেই সুযোগে কিছু আসামি জেল থেকে পলায়ন করে। যারা জেল থেকে পালিয়েছে তাদের সবাইকে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে বেশকিছু জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। তারা অপরাধ করতে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে। আবার বিভিন্ন জেলার ভিলেজ পলিটিক্স আবার মাথাচাড়া দেওয়ায় অস্ত্রগুলো প্রভাবশালীদের হাতে চলে যেতে পারে। অস্ত্র একবার বেহাত হলে সেটি উদ্ধার করা কঠিন।

সূত্র বলছে, লুণ্ঠিত কিছু অস্ত্র অপরাধী চক্রের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ওই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ওইসব খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে যদি ওই খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হয় তাহলে সে সময় অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়তে পারে। এতে খুনোখুনির আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশ জানায়, খোয়া যাওয়া অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে যাতে পাচার হতে না পারে সে জন্য তারা শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান চালাবে। তবে এর আগেই সীমান্ত এলাকাগুলোতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-আগস্টের অস্ত্র খোয়া যাওয়ায় ডিএমপিতে ৯৮টি মামলা হয়েছে। ওই মামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুর্বৃত্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ এবং লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।