
নানা নাটকীয়তা শেষে পূর্বনির্ধারিত সময়ে হচ্ছে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। আগামীকাল বৃহস্পতিবার টোকিওতে এ বৈঠক হবে।
চলতি মাসের শেষদিকে জাপান সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর এ সফরের আগে ১৫ মে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) ঠিক হয়। তবে গত সোমবার এক চিঠিতে এ বৈঠক স্থগিত করার কথা জানায় ঢাকা। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই গতকাল মঙ্গলবার আরেক চিঠিতে নির্ধারিত তারিখে বৈঠকটি অনুষ্ঠানের কথা জাপানকে জানায় বাংলাদেশ।
এ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি। গতকাল দুপুরে তিনি আবারও জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাইদা শিনইচি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এফওসি নির্ধারিত সময়ে হতে যাচ্ছে। জাপানের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকে অর্থনীতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে আলোচনা হবে।’ তবে এফওসিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি সম্পর্কে জানা নেই বলে সাংবাদিকদের বলেন জাপানের রাষ্ট্রদূত।
অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এফওসিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকার কথা থাকলেও জসীম উদ্দিন শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েছেন। তাঁর জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) ড. নজরুল ইসলাম।
জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপানে নিক্কেই ফোরামের সম্মেলনে যোগ দেবেন। সেই সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।’ দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অংশীদার জাপান। মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিগ-বি প্রকল্পগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। যদিও চুক্তি বা সমঝোতার বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়নি।’
আগামী ২৯ মে টোকিওতে নিক্কেই ফোরামের সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এরপর তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। মূলত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে হচ্ছে বৃহস্পতিবারের এফওসি। গত এপ্রিলের শেষদিকে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠক ও প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফর নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়।
সূত্র জানায়, গতকাল পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আসন্ন বৈঠক নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আলোচনা হয়।
টোকিও বৈঠকে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জাপানকে আরও বিনিয়োগে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাবে। পাশাপাশি জাপানের পক্ষ থেকে হয়তো সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়ে জোর থাকবে।
আসন্ন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক দুটি অংশে অনুষ্ঠিত হবে। শুরুতে দু’দেশ দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। পরবর্তী অংশে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবে। এতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি তুলে ধরবে। আর জাপানের পক্ষ থেকে চীনসহ তাদের আঞ্চলিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে আঞ্চলিক বিষয়ে জাপানের বিগ-বি গুরুত্ব পাবে। ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেসঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়েও মতামত দেওয়া হবে। পরে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, সে ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দেবে ঢাকা।
গত বছরের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইনের শাসন নিয়ে একাধিকবার শঙ্কা জানিয়েছে টোকিও। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ভালোভাবে নেয়নি তারা। বিগ-বি প্রকল্পে ভারতের অন্তর্ভুক্তি জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার। এ জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার পরামর্শ এসেছে টোকিওর তরফে। বৈঠকে এবারও এ বিষয়ে জোর দেবে দেশটি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কূটনৈতিক সমকালকে বলেন, জাপানের অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য বিগ-বিতে দিল্লির অন্তর্ভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের বাস্তবতা বদলে গেছে। সম্প্রতি চীন সফরে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির কথা তুলে ভারতের এক প্রকার তোপের মুখে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা। সে বাস্তবতায় ভারতকে প্রকল্পটিতে অন্তর্ভুক্ত করে কতটুকু এগোনো সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ঢাকার। তবে একটি দেশের কারণে তো আর উন্নয়নযাত্রা থেমে থাকতে পারে না। আপাতত ভারতকে ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেবে ঢাকা। তবে দেশটির ভবিষ্যতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখতে বলা হবে।
মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার (বেল্টে) এলাকায় শিল্পায়ন সামনে রেখে বিগ-বি উদ্যোগের পরিকল্পনা। একে তিনটি স্তম্ভে ভাগ করেছে জাপান। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সমৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করতে শুরুতে বাংলাদেশ থাকলেও পরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে টোকিও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আঞ্চলিক বলয় বাড়াতে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী জাপান। এ বিষয়ে গত বছর পঞ্চম এফওসিতে একমত হয়েছে বাংলাদেশও। এবারের এফওসিতে দু’দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। সেসঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস), প্রতিরক্ষা, মেরিটাইম সিকিউরিটি, বাণিজ্য, বিনিয়াগ, কৃষি, কানেকটিভিটি, অবকাঠামোগত সহযোগিতার মতো বিষয়ও থাকবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করবে দু’দেশ।
বৈঠকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু বিষয়ে আলোচ্যসূচিতে এ অঞ্চলে জাপানের সহযোগী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তনি-ইসরায়েল, নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতা এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে সমর্থনের মতো বিষয় রয়েছে। বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার যেসব চুক্তি হয়েছিল, সেগুলোর হালনাগাদ বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও ঢাকা আগের মতো এ বিষয়ে জোর দেবে।