
রাজধানীর ‘জিরোপয়েন্ট’ সংলগ্ন জিপিও (জেনারেল পোস্টঅফিস) ভবনের সম্পত্তির ওপর আবারো পড়েছে শকুনি দৃষ্টি। মানুষের নাম-পরিচয়, আবেগ-অনুভুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ডাক বিভাগের এই স্থাপনার ওপর এবার লোভাতুর চোখ পড়েছে আমলাদের। নতুন ছুতোয় চাইছে কয়েক শ’ বছরের প্রাচীন ডাক বিভাগের সম্পত্তি গ্রাস করতে। এরই অংশ হিসেবে ভবনের স্থানে সচিবালয়ের এক্সটেনশন ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ফলে জিপিও ভবন ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা-প্রস্তাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। হতাশা নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি মধ্যে। ভবনটিকে ‘পরিত্যাক্ত ও অব্যবহৃত’ দাবি করে সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়েছে ভেঙে ফেলার প্রস্তাব। আর এতে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারির মাঝে। ডাক বিভাগের ইতিহাস বর্ণাঢ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ডাক কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। ১৮৭৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টবেঙ্গল পোস্টাল সার্কেল। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত ভারতে আসাম-বেঙ্গল পোস্টাল সার্কেল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকার সদরঘাটে স্থাপিত হয় প্রথম জেনারেল পোস্ট অফিস বা জিপিও।
১৯৫০ সালে ঢাকার সদরঘাট থেকে জিপিও গুলিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬২ সালে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বর্তমান তিন তলা ভবন স্থাপন করা হয়। ভবনটির আকর্ষর্নীয় লোকেশন এবং সারাদেশের সংযোগ স্থল হিসেবে জিপিও নাগরিক অভ্যস্থতায় পরিণত হয়। কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় জিপিওর সুপরিসর আঙ্গিনা, আকর্ষনীয় লোকেশন। ফলে বিভিন্ন সময় সুবিধাভোগী মহল এটিকে ‘নিজের’ করে নেয়ার চেষ্টা চালায়। এ ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার আমলে একবার ভবনটির জমি গ্রাসের একটি চেষ্টা চলে। তৎকালিন দুর্নীতিবাজ মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র শেখ হাসিনার কৃপাদৃষ্টিতে পড়ার লক্ষ্যে জিপিও ভবনের স্থানটিতে কয়েক শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ফাঁদেন। জিপিরও সুপ্রশস্ত জমিতে শেখ মুজিব এবং শেখ রাসেলের নামে দৃষ্টিনন্দন উদ্যান তৈরির প্রস্তাবনা জমা দেন। কিন্তু ব্যপক দুর্নীতির দায়ে এসএস ভদ্রকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।
কিন্তু থেমে নেই স্বার্থান্বেষী আমলারা। যেখানে গোটা সচিবালয়কেই অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কথা, সেখানে বিদ্যমান স্থানে সচিবালয় রেখে এটিকে বরং সম্প্রসারিত করার পাঁয়তারা করছেন। বিষয়টি এমন যে, দেশের সকল প্রশাসন ক্যাডারকে সচিবালয়ের ভেতরেই বসার ঠাঁই করে দিতে হবে! এমনই এক পরিকল্পনা থেকে নবোউদ্যোমে গ্রাস করতে চাইছে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তি। এ কাজে যুক্ত করতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার দফতরে। চিঠিতে জিপিও ভবনটিকে ‘পরিত্যক্ত’ ও ‘অব্যবহৃত’ দারি করা হয়। একই সঙ্গে জিপিওর ভবনের জায়াগাটিতে বাংলাদেশ সচিবালয়ের এক্সটেনশন হিসেবে সচিবালয়ের মাস্টার প্ল্যানের অন্তর্ভুক্তি ও হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ ঘটনাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জিপিও ভবন মোটেও পরিত্যক্ত এবং ব্যবহার অনুপযোগী নয়। বরং এটি একটি ‘কেপিআই স্থাপনা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। এই ভবনে এখন ডাক বিভাগের ২৪টি অপারেশনাল অফিস নিরাপদ, নির্বিঘেœ কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখান থেকে ডাক সেবা নিচ্ছেন। ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের এই কেন্দ্রটি কখনোই পরিত্যক্ত ছিল না। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ডাক সেবা থাকবে, ততোদিন এটি পরিত্যক্তও হবে না। ডাক অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয় শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ‘ডাক ভবন’ এ স্থানান্তর করা হয়েছে বটে। কিন্তু ডাক সেবার অন্যান্য অপারেশনাল অফিসগুলো জিপিও কম্পাউন্ডেই অবস্থিত।
ডাক বিভাগের কোনো ধরণের মতামত ছাড়া এ ধরনের চিঠি প্রেরণ এবং সেটি উপদেষ্টার দফতরে উপস্থাপনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কারণ, জিপিও ভবন শুধুমাত্র একটি নিছক একটি কংক্রিটের স্থাপনা নয় । এটি ডাক বিভাগের অন্তত ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রাণের জায়গা। তাদের গর্ব ও ডাক সেবার ঐতিহ্যের প্রতীক। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ডাক বিভাগের এই ভূ-সম্পত্তি কেড়ে ে নেয়ার যেকোনো উদ্যোগকে আমরা সরাসরি দেশের ডাক সেবার ওপর আঘাত হিসেবেই বিবেচনা করি।
ডাক বিভাগের সকলস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী দৃঢ়ভাবে দাবি জানাচ্ছে যে, অবিলম্বে এই প্রস্তাব বাতিল করতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরণের যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে ডাক বিভাগের সঙ্গে পরিপূর্ণ আলোচনা ও সম্মতি নিতে হবে।