
দুর্ঘটনায় প্রবাসী ছেলের দুই পা পুড়ে গেছে। এ জন্য বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি দিতে পারেননি জহুরুল ইসলাম (৫৫)। এতে দুই ক্রেডিট অফিসার সদ্য বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জহুরুলকে অপমান করেন। ডেকে আনেন অফিসে। সেখানে কিস্তি দিতে দুই দিন সময় চান জহুরুল। কিন্তু তাকে সময় দেওয়া হয় না। তখন এনজিও অফিসেই বিষপান করেন তিনি।
জহুরুল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বাড়ি জেলার পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ নয়াপাড়া গ্রামে। গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকায় যশোরের বেসরকারি সংস্থা রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশনের (আরআরএফ) শাখা কার্যালয়ের ভেতরে জহুরুল বিষপান করেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ঘাস মারা বিষ পানে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। জহুরুলের ক্ষেত্রেও যেকোনও সময় যেকোনও কিছু ঘটতে পারে। তার শরীরিক অবস্থা ভালো নয়।
রাজশাহী অঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-যুবক-যুবতী কেউই বাদ যাচ্ছে না। গত এপ্রিলে রাজশাহীতে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ জন। তবে এর বাইরেও আরও অনেকে রয়েছেন, যেগুলো পুলিশের তালিকায় নাই।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ, সংসারে অভাব-অনটন, পরকীয়া এবং যুবক-যুবতীদের পছন্দমতো বিয়ে না হওয়া, ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়া, আত্মধারণা বা আত্মবিশ্লেষণের ঘাটতির কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আত্মহত্যা কমাতে নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদে তার অধিকার নিশ্চিত করা, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধে সহজ শর্ত আরোপ, সব হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা কাউন্সেলিং চালুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের অভিমত, মনোরোগ চিকিৎসাকে পাগলের চিকিৎসা না মনে করে তা স্বাভাবিকভাবে নেওয়া এবং পরিবার ও সমাজকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে চিকিৎসার ফলোআপ না করলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
গেলো মাসের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের দিন রাজশাহীর নন্দনগাছি স্টেশনে ষাটোর্ধ রুহুল আমিন খুব ঠান্ডা মাথায় ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পরিবার থেকে জানানো হয়, ঋণের বোঝা বইতে না পেরে তার এমন সিদ্ধান্ত। একইভাবে ২০২৪ সালের জুনে পুঠিয়ার তরুণী রেমীর আত্মহত্যার ভিডিও তখন দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করে।
হাসপাতালের তথ্য ও গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজশাহীতে চলতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যা। এর মধ্যে– ১১ জানুয়ারি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান, ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের এএসআই আমিনুল ইসলাম, ২১ ফেব্রুয়ারি রাবি শিক্ষার্থী সিফাতুল্লাহ, ১ মার্চ দুর্গাপুরে দুজন গৃহবধূ বিষপান করেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আরও ছয় জন। ৬ এপ্রিল আটতলা ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আমেরিকা প্রবাসী ফারিহা নাজনীন, ২০ এপ্রিল পুলিশের কনস্টেবল মাসুদ রানা।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউনিয়নের কলেজছাত্রী বিলকিস নাহার (২৬) শুক্রবার (৯ মে) রাতে গলায় ফাঁস নেন। তিনি রাজশাহীর বাগমারা যোগিপাড়া ইউনিয়নের ভাগনদী গ্রামের বজলুর রহমানের মেয়ে। পাশের গ্রাম কাতিলায় নানার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। শনিবার সকালে নানার বাড়ি থেকে পুলিশ তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। পুলিশ বলেছে, মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিলকিস নাহার দীর্ঘদিন ধরে নানার বাড়িতে বসবাস করছিলেন। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর একটি কলেজে মাস্টার্সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি নানার বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। শুক্রবার গভীর রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার বাঁশের তীরের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
একাধিক সূত্র জানায়, শুক্রবার (৯ মে) বিলকিস নাহার বাবার বাড়িতে যান। সেখান থেকে নানার বাড়িতে ফিরে রাতে ফাঁস নেন।
বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক আবদুল করিম বলেন, ‘বিলকিস নাহার মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া বিয়ে না হওয়াতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এসব অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ ওই ছাত্রীর বাড়ি থেকে চিকিৎসকের কিছু ব্যবস্থাপত্র উদ্ধার করে। এ বিষয়ে বাগমারা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল মর্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে আত্মহত্যার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য আসছে। হাসপাতালের মুখপাত্র জানান, শুধু এপ্রিল মাসেই তারা এ ধরণের মরদেহ বা মৃত্যুর ঘটনা পেয়েছেন ৩৫টি। এর বাইরেও রয়েছে আরও বড় সংখ্যক অংশ; যারা পুলিশি তদন্তের বাইরে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শংকর কে বিশ্বাস বলেন, ‘বর্তমানে দেশে প্রতি লাখে চার জন আত্মহত্যা করছে। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীই বেশি। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্করা আত্মহত্যা করছেন ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে কিংবা সাংসারিক ঝামেলায়। তবে যারা বেঁচে যাচ্ছেন তারা পরবর্তী সময়ে ফলোআপ চিকিৎসা না নেওয়ায় ঝুঁকি কাটছে না।’
আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে ৩১০ জন আত্মহত্যা করেন। ২০২২ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৫৩২ ও ২০২৩ সালে ৫১৩। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যার খবর হয়তো গণমাধ্যমে কম এসেছে বলে তারা ধারণা করছে।
ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ সালে ১৩-১৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে, যা মোট আত্মহত্যার ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছে ২৬-৩০ বছর বয়সীরা। আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশ নারী। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আত্মহত্যার ঝুঁকিতে বেশি নারী শিক্ষার্থীরা। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সহায়তা বেশি প্রয়োজন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার বানুর বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়াও পারিবারের সদস্যদের সহায়তা, প্রশাসনের সহায়তা এবং মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রবণতা গড়ে তুলতে হবে।’