
দুর্নীতি, সক্ষমতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নিম্নমানের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা স্বাস্থ্য খাতের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সেবা ব্যবস্থাপনার ২০টি দুর্বল দিক স্বাস্থ্য খাতকে অচল করে রেখেছে। এর তালিকা পাওয়া গেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। গত সোমবার এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয় কমিশন।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যেসব দুর্বল দিক চিহ্নিত করেছে, এর মধ্যে একটি হলো সেবা প্রদানকারীর স্বল্পতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মোতাবেক এসডিজি-৩ (সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ) অর্জনের জন্য প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য ২০২৫ সালে ৩১.৫ জন এবং ২০৩০ সালে ৪৪.৫ জন সেবা প্রদানকারী থাকার কথা। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে কর্মরত আছে ১১.৭০ জন।
বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতে প্রথম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত অনুমোদিত পদ দুই লাখ ৩৬ হাজার ৮২৮টি। এর মধ্যে কর্মরত মোট জনবল এক লাখ ৭৩ হাজার ২৬১ জন। মোট ৬৩ হাজার ৫৭১টি পদ শূন্য রয়েছে, যা মোট পদের ২৭ শতাংশ। কোনো কোনো শ্রেণির কর্মচারীর পদের শূন্যতার হার গ্রামীণ এলাকায় ৪০ শতাংশ। পক্ষান্তরে শহর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রদানের জন্য রয়েছে নামমাত্র অবকাঠামো।
স্বাস্থ্য খাতে আরেকটি বড় দুর্বল দিক হলো স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অভাব এই দেশে প্রকট। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত দক্ষ জনবল প্রায় অনুপস্থিত। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এ ধরনের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটির যথাযথ অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। উপজেলা এবং কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটি সাধারণত তৈরি করা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব কমিটিকে কোনো দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের মধ্যে কোনো জবাবদিহি তৈরি হয় না।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাপনার কিছু দুর্বল দিক উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো—অবকাঠামোগত দ্বৈততা; ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা; উপকরণের অভাব; ওষুধ, সেবা ও উপকরণের অহেতুক উচ্চমূল্য; ভুল সিদ্ধান্ত তথা অগ্রগণ্যতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব; সেবা প্রদানকারীদের সময় ও সেবাকাজে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগের অভাব; প্রশংসনীয় সেবার জন্য পুরস্কার এবং অসন্তোষ উদ্রেককারী সেবা প্রদানের জন্য শাস্তির ব্যবস্থার সংস্কৃতির অনুপস্থিতি।
এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সময়মতো বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা; উচ্চশিক্ষিত জনস্বাস্থ্যবিদদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা না দেওয়া; জনগণের মধ্যে তথ্য প্রচারে দুর্বলতা; সেবা প্রদানকারীদের পরিপূর্ণ দলের অভাব; উচ্চ পরিমাণে পদ শূন্যতা; স্বাস্থ্য প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা; সেবা কাজে সুচারু পদ্ধতি অনুসরণের অভাব; রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগারের দুর্বলতা; আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, এসব পরিচালনায় দক্ষতার অভাব এবং দক্ষ সেবা প্রদানকারীর স্বল্পতা; কর্মসূচি পরিচালনায় অর্থের অভাব; সংরক্ষণ ও মেরামতে দীর্ঘসূত্রতা; ক্রয় ও সংগ্রহ কাজে অপরাধপ্রবণতা; স্বাস্থ্যসেবা কাজে দালাল ও ওষুধ কম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি।
স্বাস্থ্য খাতের এসব সমস্যার সমাধান কতটা সম্ভব হবে—এমন প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিকিৎসাব্যবস্থাকে সাজিয়েছেন। কারণ সে সময় দেশে একটা আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ ছিল। মানুষ কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক অপচিকিৎসায় অভ্যস্ত ছিল। এখন সব কিছু বদলে গেছে, কিন্তু চিকিৎসাব্যবস্থার পরিবর্তনটা হয়নি। পরিবর্তনটা জরুরি।’
তিনি বলেন, সুপারিশগুলো ভালো। মৌলিক কিছু বিষয় পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কিছু বিষয় আছে, অংশীজনদের সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। এ জন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখতে হবে। তাদের আপত্তির অজুহাতে যেন উদ্যোগটা ব্যাহত না হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো একটি ন্যায্য, মানবিক ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনের পথে দৃশ্যমান বাধাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি, জরুরি চিকিৎসা ও মানসম্মত সেবার অপ্রতুলতা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তি পর্যায়ে খরচ জনগণের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাত আজ এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সুপারিশগুলো সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখানে সমস্যা ও সমাধানের বিষয়েও বলা হয়েছে। তবে সেটি সময়সাপেক্ষ, রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। যেমন—স্বাস্থ্য সেবাদান ও ভৌত অবকাঠামো, নেতৃত্ব, সুশাসন ও কর্মসংস্কৃতি, স্বাস্থ্য জনবল ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য জনবলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ, স্বাস্থ্য অর্থায়ন ও স্বাস্থ্য তথ্যব্যবস্থা। এসব সমস্যা ধরে ধরে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।