
জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিপরিষদ, পুলিশ বাহিনীসহ সবাইকে আন্দোলন দমাতে যা যা করা দরকার তা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা এই পরিকল্পনা সাজানো থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে কাজ করেন। জুলাই গণহত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে পৃথক ২২টি অভিযোগ (মিস কেস) দায়ের করা হয়। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনসহ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীদের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বাদী হয়ে দায়ের করা ওই অভিযোগের মধ্যে একটি মামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে তদন্ত সংস্থা। সোমবার ওই প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি শুক্রবার যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদনে গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বহু প্রমাণ ও উপাত্ত রয়েছে। কখনো সরাসরি, কখনো টেলিফোনসহ নানা মাধ্যমে গুলির নির্দেশ দিয়ে তা আবার নিশ্চিতও করেন শেখ হাসিনা। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার স্পষ্ট নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি। এক কথায় গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা। আর আইনের ভাষায় এ গণহত্যার সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি শেখ হাসিনারই।
তদন্ত ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবির আন্দোলন ও পরবর্তী সহিংসতায় ৩ দিনেই (৪-৬ আগস্ট) অন্তত ৩২৬ জন নিহত হন। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগের দিন (৪ আগস্ট) দুদফা উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে ওই দিনের কর্মসূচি সশস্ত্র মোকাবিলার পরিকল্পনা করা হয়। ৪ আগস্ট সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে সেনা-বিমান-নৌবাহিনী, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানরা অংশ নেন। বৈঠকে হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (গণভবন) আরেকটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে অংশ নেন। অন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল। বৈঠকে একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়, শক্তিপ্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ ঠেকিয়ে দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ খেতাবি দিয়ে তাদের সশস্ত্রভাবে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে। এ মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে সারা দেশে গণহত্যা চালায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছিলেন সব গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট সোমবার চিফ প্রসিকিউটর বরাবরে দাখিল করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তাজুল ইসলাম। তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের সব বিষয় তিনি সবিস্তারে উল্লেখ করেননি।
২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছিলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন যে কোনো মুহূর্তে দাখিল হতে পারে।
ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুকুমে গুম-খুনের সব ঘটনা সংঘটিত হয় মর্মে জানা যায়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা ও গুমের দুটি আলাদা মামলা তদন্তাধীন। মিস কেস-২ মামলাসহ দুটি মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন-পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তাদের বিরুদ্ধেও গণহত্যায় সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনাসহ তারা সবাই গণহত্যার নির্দেশদাতা। তারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বৈধ ও অবৈধ প্রক্রিয়ায় সরকারি বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
২ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার মামলার একটি খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তিনি সেদিন বলেন, খসড়া প্রতিবেদনটি এখন প্রসিকিউশনের হাতে রয়েছে। প্রতিবেদনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গণহত্যা চালানোর অজস্র প্রমাণ উঠে এসেছে। শিগগিরই প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে।
শুক্রবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট সোমবার চিফ প্রসিকিউটর বরাবরে দাখিল করবে আশা করছি। তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অর্থাৎ ‘ফরমাল চার্জ’ দাখিলের মাধ্যমে হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে।
তিনি লেখেন, ‘ইতোমধ্যে চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের দায়ে সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ে আনুষ্ঠানিক বিচারের জন্য ফরমাল চার্জ চলতি সপ্তাহেই দাখিল করা হবে এবং এর মাধ্যমে জুলাই গণহত্যার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।’
জানতে চাইলে তাজুল ইসলাম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে যা লেখেছি তা সঠিক। এর বাইরে কিছু বলতে পারব না। সোমবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিবে তদন্ত সংস্থা।
ছাত্র-জনতান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকান্ডের বিচার ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হিসাবে আছেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ইতোমধ্যে বিচার ত্বরান্বিত করতে গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
সব গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা : প্রসিকিউশনের একটি সূত্র জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা, আশুলিয়া ও চানখাঁরপুলে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে শতাধিক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। এসব ছাড়াও সারা দেশে সব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য সারা দেশে গণহত্যা চালায়।
প্রসিকিউশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৩০টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যেখানে ৩৯টি তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেস হয়েছে ২২টি। এসব মিস কেসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন ৫৪ জন, আর ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক ৮৭ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তি হচ্ছেন ৭০ জন, পুলিশ ৬২ জন, আর সামরিক হচ্ছেন ৯ জন। ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া : ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, যে কোনো ভুক্তভোগী তদন্ত সংস্থা কিংবা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। চিফ প্রসিকিউটরের কাছে দাখিলকৃত অভিযোগ পরবর্তী সময়ে তদন্ত সংস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রাপ্ত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবে। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে আসামি গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট চাইতে পারেন। গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অনুমতি চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে একটি ‘মিস কেস’ চালু হয়। তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরে চিফ প্রসিকিউটর ফরমাল চার্জ প্রস্তুত করে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। ট্রাইব্যুনাল ফরমাল চার্জ গ্রহণ করার পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করবেন। যেসব আসামি গ্রেফতার আছেন, তাদের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মাধ্যমে মূল কার্যক্রম শুরু হবে।
১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টা ও গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।