Image description

দেশের উষ্ণতম মাস এপ্রিল। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ মাসে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যায়। তাই বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিতে হয়। গত দুই বছর এপ্রিলে বড় ধরনের লোডশেডিং দেখা গেছে। তবে এ বছরের এপ্রিলে তেমন লোডশেডিংয়ের মুখে পড়তে হয়নি।

এ বছরের এপ্রিলে লোডশেডিং কম হওয়ার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও লোডশেডিং কমাতে বড় ভূমিকা রেখেছে আবহাওয়া পরিস্থিতি।

গত বছরের এপ্রিলজুড়ে তাপপ্রবাহ ছিল। গত বছরের এপ্রিলে দিনের গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে এবারের এপ্রিলে তা কমে আসে ৩৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অর্থাৎ এবারের এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা কমেছে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়ার কারণে কিছুটা সুবিধা পাওয়া গেছে। তবে এবার চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এপ্রিলের আগেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি রাখা হয়েছিল। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। সরবরাহব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া হয়। চাহিদা আরও বেশি হলে সে অনুসারে উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল।

গত এপ্রিলে তাপমাত্রা কম থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে স্বস্তিতে ছিল পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিলের অধিকাংশ দিনে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও লোডশেডিং দিতে হয়েছে। এবারের এপ্রিলে একই রকম উৎপাদন করেই চাহিদা মেটানো গেছে।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় গত বছরের ৩০ এপ্রিল। সেদিন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও ৪৯৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়। আর এ বছর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় গত ২৪ এপ্রিল, ১৬ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। একই সময়ে লোডশেডিং হয়েছে ১৩৯ মেগাওয়াট। এ বছরের এপ্রিলে দিনে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে ৪২৮ মেগাওয়াট। গত বছরের এপ্রিলে তা ছিল ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর টানা বেশ কিছু দিন তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। গত বছরের এপ্রিলে মোট ২০ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩০ এপ্রিল—৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবারের এপ্রিলে এক দিনের জন্যও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়নি। এবারের এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ ও ২৫ তারিখে, ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরির পর টানা কয়েক বছর দেশে তেমন লোডশেডিং ছিল না। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানি সংকট তৈরি হয়। জ্বালানির অভাবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় দেখা দেয় লোডশেডিং। এর পর থেকে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ে ভুগতে হচ্ছিল সাধারণ ভোক্তাদের। গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে এবার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বাড়ে। তবু লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা ছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়, গ্রীষ্ম মৌসুম লোডশেডিংমুক্ত রাখা যাবে না। তবে লোডশেডিং সীমিত রাখার চেষ্টা করা হবে।

এবার উৎপাদন তেমন বাড়েনি

গত বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে অল্প করে লোডশেডিং শুরু হয়। মাসটির শেষ দিকে কোনো কোনো দিন তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো হয়। এরপর এপ্রিলে লোডশেডিং বাড়তে থাকে। কোনো কোনো দিন তা ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়।

এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম মোকাবিলায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি খাতের সব বকেয়া শোধ করা হয়। বিদ্যুৎ খাতের বকেয়াও কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া আগের চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়ে ১ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের এপ্রিলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২৬ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার মেগাওয়াট।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নিয়ে সভা হয়। সভা শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এবারের গ্রীষ্মে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহারে সতর্ক করেন তিনি। পবিত্র রমজান ও গরমের মৌসুমে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখলে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে বলে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন উপদেষ্টা। এ নিয়ে পরে পরিপত্রও জারি হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, এবারের গ্রীষ্ম সামনে রেখে এপ্রিলে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা ধরা হয়েছিল। যদিও এপ্রিলে সর্বোচ্চ চাহিদা পাওয়া যায় ১৭ হাজার মেগাওয়াট, তাও মাত্র এক দিন। এবারের এপ্রিলে অধিকাংশ দিনেই বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াটের নিচে।

পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিলে ভারত থেকে আমদানিসহ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৯ হাজার ২২৭ মিলিয়ন ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা)। গত বছরের এপ্রিলে ঈদের ছুটি থাকায় এক সপ্তাহ বিদ্যুৎ চাহিদা কম ছিল, উৎপাদনও কম হয়। এবারের এপ্রিলে টানা ছুটি ছিল না। তাই একই হারে উৎপাদন হয়েছে। মোট উৎপাদন হয় ৯ হাজার ২৭৯ মিলিয়ন ইউনিট। আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে এবার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫২ মিলিয়ন ইউনিট, যা এক শতাংশেরও কম। তার মানে উৎপাদন তেমন না বাড়িয়েও এবার পরিস্থিতি সামলানো গেছে।

বৈশাখী ঝড়বৃষ্টিতে স্বস্তি

পিডিবির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আবহাওয়ার তারতম্যের সঙ্গে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়ে-কমে। শীতের সময় দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা ৮ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াটে নেমে যায়। সে সময় লোডশেডিং করার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে গরমের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে হিমশিম খায় পিডিবি। এরপর বর্ষার কারণে জুন-জুলাইয়ে বিদ্যুৎ চাহিদা আবার কমে যায়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়ে। অক্টোবর থেকে তাপমাত্রা কমতে থাকে। ফলে তখন লোডশেডিংও কমে।

গত বছরের এপ্রিল মাসে টানা যত দিন তাপপ্রবাহ হয়েছিল, তা ৭৬ বছরে হয়নি। তখন তাপপ্রবাহ হয়েছিল ১ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত—টানা ৩৫ দিন।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, গ্রীষ্মের উষ্ণতা প্রশমিত করে কালবৈশাখী ঝড়। এতে প্রবল বৃষ্টি হয়। ফলে কয়েক দিনের জন্য হলেও কমে যায় তাপ। তারপর আবার তাপ বাড়ে। গত বছর এপ্রিল-মে মাসে অস্বাভাবিক ও টানা তাপপ্রবাহের কারণ কালবৈশাখী কম হওয়া। সাধারণত এপ্রিল মাসে ৯ দিন ও মে মাসে ১৩ দিন কালবৈশাখী হয়। কিন্তু গত বছরের এপ্রিলে মাত্র ২টি, মে মাসে ৪টি কালবৈশাখী হয়েছিল। এ বছরের এপ্রিলে কালবৈশাখী হয়েছে অন্তত ৯টি। তা ছাড়া এপ্রিলজুড়ে প্রায়ই বৃষ্টির দেখা মিলেছে।

পিডিবি সূত্র বলছে, এবার এপ্রিলে বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল নাগালের মধ্যে, যা সহজেই পূরণ করতে পেরেছে পিডিবি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ধরে রাখতে গিয়ে এবার আগের চেয়ে ভর্তুকি বেড়েছে সংস্থাটির।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বিদ্যুৎ উৎপাদন তেমন বাড়াতে হয়নি। অথচ ভর্তুকি বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ খরচ কমানোর বদলে বেড়ে গিয়ে তা আরও জটিলতা তৈরি করল এই খাতে।