
তুচ্ছ কারণে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘সমন্বিত অপরাধের’ ঘটনা ঘটেই চলেছে। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক বিষয়ে মতের মিল না হলেই মবের মাধ্যমে পিটিয়ে হত্যা বা আহত করা হচ্ছে। মবের সুযোগ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে অন্যায় স্বার্থ হাসিল করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও চাকরিচ্যুতিতেও মবের সুযাগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, ২০২৪ সালে মবসংশ্লিষ্ট গণপিটুনির ঘটনায় সারা দেশে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসিনার পতনের পরের চার মাসে এ সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ৮ মাসে সারা দেশে মব বিশৃঙ্খলায় মারা গেছেন ১৪৩ জন।
অপরাধ গবেষক ও আইনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে মব ভায়োলেন্সের ঘটনা অনেক কম। তবে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিবেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী আইন হাতে তুলে নেয়। তারাই মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঢিলেঢালা ভাব ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মব সৃষ্টি করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। মব জাস্টিস সহ্য করা হবে না বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ গবেষক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা স্বার্থে মব ভায়োলেন্স সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখনই শক্তভাবে প্রতিরোধ করা না গেলে তা ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়বে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত মব তথা গণপিটুনির ঘটনায় সারা দেশে ৩২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ৮ মাসে গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৩। আসকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পট পরিবর্তনের পরের ৪ মাসে মৃত্যু হয় ৯৬ জনের। এ সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবমিলিয়ে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের ৮ মাসে গণপিটুনিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৩ জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারিতে ১৬ জনের মৃত্যু হয়, যেখানে ঢাকায় ৭ জন। ফেব্রুয়ারিতে মারা যাওয়া ১১ জনের মধ্যে ঢাকায় ৩ জন। মার্চে ২০ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ঢাকায় ১৪।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালে ২০১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত এবং ৮৮ জন আহত হন। ২০২৩ সালে ১১৪টি ঘটনায় ৭৩ জন নিহত এবং ৯১ জন আহত হন। সে হিসাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনায় ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন।
গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হন। বোয়ালিয়া থানার ওসি জানান, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে বিনোদপুর বাজারে মাসুদকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথি কক্ষে তোফাজ্জেল হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জানা যায়, ওইদিন রাতে হলের ছাত্রদের মানিব্যাগ ও ফোন চুরির ‘অভিযোগে’ তাকে দফায় দফায় মারধর করে কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে মারা যান তোফাজ্জেল।
২৭ এপ্রিল গাজীপুরের পূবাইলে এক কিশোরকে বলাৎকারের অভিযোগ তুলে মসজিদের এক ইমামকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার ৬ দিন পর ওই ব্যক্তির স্ত্রী থানায় মামলা করেন। অভিযোগ করা হয়, বিরোধী পক্ষের একজনের ছেলেকে বলাৎকারের (ধর্ষণ) নাটক সাজিয়ে তার স্বামীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে মাথার চুল কেটে জুতার মালা গলায় দেয় আক্রমণকারীরা। মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
২৯ এপ্রিল রাজধানীর কাকরাইলে ছোট পর্দার অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমানকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে উত্তেজিত জনতা। ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ উল্লেখ করে স্লোগান তুলে একদল জনতা তার দিকে তেড়ে যায়। একপর্যায়ে তাকে মারধর করে ও পোশাক ছিঁড়ে ফেলে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব ভায়োলেন্স বা জাস্টিসের মাধ্যমে অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে কোনো ব্যক্তিকে অবমাননা, মারধর, হত্যা বা সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে সাজা দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পান না। উচ্ছৃঙ্খল জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। মব জাস্টিসের মাধ্যমে কোনো ন্যায়বিচার হয় না। এ ধরনের মব বা গণপিটুনি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, উন্নত বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্সসহ অন্যান্য অপরাধ কম। তবে পট পরিবর্তনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী মব ভায়োলেন্স করছে। পরিস্থিতির আরও উন্নতি হলে মব বিশৃঙ্খলা কমে আসবে। পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, মবের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃশ্যমান শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধীরা ছাড় পেলে সমাজে ভিন্ন বার্তা যাবে।
মব জাস্টিস আর অ্যালাউ (অনুমোদন) করা যাবে না বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সম্প্রতি যশোরে সশস্ত্র বাহিনী ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি আরও বলেছেন, ‘অনেক হয়েছে। কারও কোনো কিছু বলার থাকলে আইনের আশ্রয় নেবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।’
জানতে চাইলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-ক্রাইম) ড. মো. আশরাফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মবের প্রতিটি ঘটনার পরপরই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি গাজীপুরের ঘটনায়ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপরাধী যেই হোক, পার পাওয়ার সুযোগ নেই।