
বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসন। যিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ নামে বেশি সমাদৃত। জনগণের দেওয়া এই খেতাবকে তিনি বারবার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। গণতন্ত্রের জন্য তার আপসহীন লড়াই সংগ্রাম নেতাকর্মীদের বেশি করে উজ্জীবিত করেছে। চিকিৎসার জন্য চার মাস আগে বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডন গেলে অনেকে নানারকম গুজবের ফানুস উড়ান। কেউ বলেন, তিনি আর দেশে ফিরতে পারবেন না। কেউ আবার মাত্রা বাড়িয়ে বলেন, খালেদা জিয়া নিজেই আর ফিরে আসবেন না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ, সংস্কার, গণহত্যার বিচার এবং ভূ-রাজনৈতিক চরম অস্থিরতার মধ্যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) দেশে ফেরা নিয়ে গুজবের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। তবে নেতিবাচক সব পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে তিনি অবশেষে ফিরে এলেন এবং জয় করলেন।
‘রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ বেগম খালেদা জিয়া যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করেন তখন তাকে একনজর দেখতে লাখ লাখ জনতা রাজপথে নানা স্লোগানে মুখর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নানা কারণে দেশে এখন খালেদা জিয়ার মতো একজন আপসহীন নেত্রীর উপস্থিতি বেশি প্রয়োজন ছিল। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি এখন ফ্যাসিস্টবিরোধী সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির কাছে সর্বজন গ্রহণযোগ্য মুরব্বি। ফলে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে নানা জটিল সমীকরণে আটকে থাকা রাজনীতিতে স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্ট কেন্দ্র করে যেসব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের মধ্যে সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তা দূর করার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া একটি ভূমিকা রাখতে পারবেন, যদি তিনি চান। কারণ এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক ধরনের অভিভাবকত্ব পেয়েছেন, তার ওপর সবার আস্থা রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম মঙ্গলবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের এই সময়ে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার ফিরে আসা আমাদের গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে আরও সহজ করবে। দেশকে সঠিক ও বৈষম্যহীন পথে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের শিকার। ফ্যাসিবাদ বিদায় নেওয়ার পর কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। এটা আমাদের জন্য, জাতির জন্য একটি আনন্দের দিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গোটাবিশ্বে আমরা দুই ধরনের নেতৃত্ব দেখেছি। এক ধরনের নেতৃত্ব যারা ক্ষমতায় থেকে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিতকরণের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আরেক ধরনের নেতৃত্ব দেখেছি যারা রাজপথে থেকে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করেছেন। এই দুটি চরিত্র একই ব্যক্তির মধ্যে যদি দেখতে চান তা বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া আর কোনো উদাহরণ আমি দেখছি না। একই ব্যক্তি সংসদীয় গণতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সব কিছু তার হাতেই। আবার জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও পলায়ন না করে মাটি আঁকড়ে ধরে রেখে যে লড়াইটা তা কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া চার দশক ধরে করে যাচ্ছেন। এজন্য তার উচ্চতা অনেক উপরে। বাংলাদেশেরও সব নেতাদের সঙ্গে পার্থক্য করলে দেখা যাবে তিনি অনন্য উচ্চতায়।
তিনি বলেন, প্রায় চার দশক লম্বা সময় ধরে বেগম খালেদা জিয়ার যে অভিজ্ঞতা সরকার পরিচালনা এবং রাজপথের আন্দোলনে। এই অভিজ্ঞতায় আমারও মনে হয় জনগণও ভাববে সংস্কার এবং নির্বাচনসহ একটি নতুন দায়িত্বশীল সরকার তৈরি করার জন্য তিনি একটি ভূমিকা রাখতে পারবেন এই বোঝাপড়াতে। সুতরাং ৫ আগস্ট কেন্দ্র করে সেসব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের মধ্যে সামান্য বিষয়গুলোতে এখন যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে, তা দূর করার ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া একটি ভূমিকা রাখতে পারবেন, যদি তিনি চান। তিনি এখন অভিভাবকসুলভ ভূমিকা রাখতে পারবেন। এখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে সুযোগ্য অভিভাবকত্ব পেয়েছে। যার পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো এখন কেউ নেই।
নব্বই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জন্য ‘আপসহীন’ নেত্রী হিসাবে স্বীকৃতি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয় তখন। এরপর থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তার সেই আপসহীন মনোভাব নিয়ে গেছে নেতাকর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের কাছে এক অনন্য জায়গায়। ওয়ান-ইলেভেনে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা ভেস্তে গেলে গত ১৫ বছরে খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপি গড়ার সব অপচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবারও সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দেশের মানুষের কাছে ফিরে এসে আবারও খালেদা জিয়া প্রমাণ করলেন কারও সঙ্গে আপস নয়। তার কাছে সবচেয়ে বড় দেশ ও দেশের জনগণ। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কখনো কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগেও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে পাঠাতে নানা ধরনের চাপ দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখনও তিনি কারাগারে গেছেন, তবুও চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি।
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার গণতন্ত্র ফিরেছে বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে। গণতন্ত্রকে সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠাকরণ হয়েছে তার হাত ধরে। নব্বইয়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন, গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। ওইখানে এক দশক, এখানে ১৫ বছর-দুই যুগ লড়াই করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। আবার তিনি তিনবার ক্ষমতায় থেকেও কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য লড়াই করেছেন। এজন্যই বলছি, তিনি বারবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এখন জনগণের কাছে একটি আইকন, একটি ভরসার জায়গায় চলে গেছেন। এখন এবার ফিরে আসাটাই তাকে একেবারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। এতটা অসুস্থ অবস্থায়ও সন্তানের কাছে থেকে যাওয়াটাকে ভালো মনে করেননি, জণগণের কাছে ফিরে আসাটাকেই তিনি ভালো মনে করেছেন। এটি খুব কম রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পাওয়া যাবে।
চিকিৎসা শেষে চার মাস পর লন্ডন থেকে মঙ্গলবার দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ বিমান ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ ফিরেছেন তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরেছেন ডা. জোবাইদা রহমান। তিনি খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী।