Image description

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন রাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (রুয়া) নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। একে কেন্দ্র করে বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বড় দুই রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপিপন্থি অ্যালামনাসদের একাংশ। অপরদিকে নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সমাবেশ, উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও এবং স্মারকলিপি দিয়েছে জামায়াতপন্থি সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানকে আহ্বায়ক করে এডহক কমিটি গঠন করা হয়। এডহক কমিটির মাধ্যমে রুয়ার জীবন সদস্য হতে সাবেক শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানানো হয়। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৯ মার্চ পর্যন্ত যারা জীবন সদস্য হবেন কেবল তারাই রুয়ার নির্বাচনে ভোটার হতে পারবেন।

তবে রুয়া নিয়ে প্রথমেই বাধে বিপত্তি। গঠনতন্ত্রের ৩৬ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অ্যাসোসিয়েশনের সকল বৈধ ও নির্দিষ্ট প্রকারের সদস্য ভোটার হিসেবে গণ্য হবেন। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের ৩০ দিনের মধ্যে যারা অ্যাসোসিয়েশনের জীবন সদস্যভুক্ত হবেন, তারাও নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।’

তবে কমিটি গঠনের এক মাস পার হওয়ার পরও দুই মেয়াদে জীবন সদস্য হওয়ার সময় বৃদ্ধি করা হয়। ফলে গত মাসের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত যারা সদস্য হয়েছেন তারাও তফসিল বর্ণিত নির্বাচনে ভোটার তালিকায় ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

রাবি অ্যালামনাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি বিএনপি-জামায়াত
চরমোনাই পীরের দলে যোগ দিলেন বিএনপির সাবেক এমপি
জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অ্যালামনাসদের একাংশ অভিযোগ করেছেন, গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে দুই মেয়াদে সদস্য হওয়ার সময় বৃদ্ধির ফলে নির্দিষ্ট একটা দলের ভোটার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে একটি বিশেষ পক্ষকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে তারা এই তফসিল বাতিল এবং নির্বাচন প্রত্যাখান করেন।

রুয়া নির্বাচন বর্জন করে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অ্যালামনাসদের পক্ষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেন অ্যাডভোকেট নূর মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন। এছাড়াও নির্বাচনী তফসিল বাতিল চেয়ে নির্বাচন কমিশন বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন একই আদর্শে বিশ্বাসী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আল আমিন সিদ্দিকী।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীলনকশা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত অপশক্তিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। তাই আমরা এই প্রহসন ও বিতর্কিত নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করছি। সেইসঙ্গে এ অপশক্তি রোধে গণতন্ত্রমনা জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী রাবিয়ান অ্যালামনাসরা এই নির্বাচন বর্জন করছি।

এদিকে রুয়ার নির্বাচন বাস্তবায়নে ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নুরুল হোসেন চৌধুরীকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। নির্বাচন কমিশন ১৩ এপ্রিল একটি সংশোধিত তফসিল ঘোষণা করে। এতে ভোট গ্রহণের তারিখ ১০ মে নির্ধারণ করা হয়।

তবে বিএনপিপন্থি অ্যালামনাসদের তফসিল বাতিল চেয়ে অভিযোগ ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তির পর ক্যাম্পাসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে পূর্ব নির্ধারিত তারিখে অ্যলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনসহ তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে স্মারকলিপি প্রদান করেন জামায়াতপন্থী অ্যালামনাসরা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, আগামী ১০ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে অনেক সদস্যরা তাদের অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। রাজশাহীতে হোটেল বুকিং করেছে এবং যাওয়া আসার জন্য বাস, ট্রেন ও বিমানসহ অন্যান্য পরিবহন ব্যাবস্থা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু একটি কুচক্রিমহল এ নির্বাচন বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করছে। নির্বাচনের দিন তারিখ নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার পর যুক্তি সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া কিংবা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা জাতীয় কোন ইস্যু ছাড়া বন্ধ করা কোনভাবেই কাম্য নয়। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমরা রাজশাহীস্থ রুয়া আজীবন সদস্যরা আপনাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবো।

একই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ছাত্র সংসদ এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন যথাসময়ে নিশ্চিতের দাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এ কর্মসূচিটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেখানে ছাত্রশিবিরের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতাকেও দেখা গেছে।

বিক্ষোভ সমাবেশে এ সময় বক্তারা বলেন, রাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ থেকে নির্বাচনের আচরণবিধি সংশ্লিষ্ট একটি তারিখ এরইমধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করার নির্দিষ্ট তারিখও পার হয়ে গেছে। যে গোষ্ঠী রুয়া নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে একই গোষ্ঠী রাকসু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। রুয়া নির্বাচনে আমরা দেখতে পারবো রাকসু নির্বাচন কেমন হবে।

এদিন দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনে যুগ্ম-সাধারণ প্রার্থী অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদের বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুরের মণ্ডলের মোড়ে তার বাড়ির দরজায় তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ করে দুর্বৃত্তরা।

এ ঘটনার পর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসঊদ তার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ফ্যাসিবাদী অপশক্তির জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। কোনো রক্তচক্ষুর ভয়ংকর হুমকি-ধমকি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি! তবে তারা কখনো বাড়ি পর্যন্ত আসার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেনি। কিন্ত আজ আমার বাড়ির দরজায় গভীর রাতের অন্ধকারে হামলার সাহস দেখিয়েছে কাপুরুষের দল! এরা কারা! এদের শিকড়সহ উৎপাটনের দাবি জানাই।’

এদিকে এ হামলার প্রতিবাদে পরদিন বৃহস্পতিবার (০১ মে) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের ১২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়।

এদিকে ওইদিন দুপুরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন দুই নির্বাচন কমিশনার। ফলে ১০ মে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন স্থগিত করা হয়। কমিশনারের পদত্যাগ ও নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন তখন গণমাধ্যমকে বলেন, অ্যাডহক কমিটির বৈঠকের সিন্ধান্ত অনুযায়ী আপাতত রুয়া নির্বাচন স্থগিত করা হলো। নির্বাচন কমিশনার নুরুল হোসেন চৌধুরী ও ফজলুল হক পদত্যাগ করছেন। তাদের ভয় ভীতি দেখানো হয়েছে, তারা যেন নির্বাচন কমিশনের কাজ না করেন।

তবে নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে ইসলামি ছাত্রশিবির। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের বাসভবন ঘেরাও করে অবস্থান নেন তারা। সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে কর্মসূচির একপর্যায়ে তারা বাসভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এসময় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘১০ মে রুয়া নির্বাচন না হলে আন্দোলন অহিংস থেকে সহিংসতে যেতে পারে।’

দুই নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের পর শুক্রবার (০২ মে) নতুন অ্যাডহক কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক একরামুল হামিদকে এডহক কমিটির আহ্বায়ক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলামকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে রুয়ার অফিশিয়াল ওয়েব সাইটে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রুয়ার গঠনতন্ত্রের ৩২(ঙ) ধারার বিধান অনুযায়ী রুয়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিম্নরূপ এডহক কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। এই কমিটি ও নির্বাচন কমিশন রুয়ার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।’

শনিবার এডহক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক একরামুল হামিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন সদস্য আহ্বান করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গঠনতন্ত্রের ৩৬ (ঙ) ধারা মোতাবেক আগামী ৩১ মে ২০২৫ তারিখের মধ্যে যারা জীবন সদস্য হবেন তারা কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন ২০২৫ এ ভোটার হিসেবে গণ্য হবেন।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের বক্তব্য নিতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন কালবেলাকে বলেন, সাবেক দুইজন নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করায় আমরা নির্বাচন স্থগিত করেছি। পরে রুয়ার পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন এডহক কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ কমিটি আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করবেন।

উপ-উপাচার্য আরও বলেন, ছাত্রশিবির ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা রুয়া নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে। রুয়া নির্বাচন না হলে রাকসুও হবে না এমন আশঙ্কা থেকে তারা এমনটি করেছে বলে আমরা জেনেছি। রাকসু এবং রুয়া আলাদা বিষয়। রাকসু নির্বাচনের জন্যও কমিশন করা হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

রেজিস্ট্রারের বাড়িতে হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করেছি। তারা এটি নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেও আমরা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করেছি।