
‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অধ্যাদেশের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এদিকে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নামে একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। মঙ্গলবার এ অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
এতে সাইবার নিরাপত্তা আইনের আগের ৯টি ধারা বাতিল করেছে সরকার। মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক নিয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া উপস্থাপন করা হয়। কিছু সংশোধন শেষে এই সপ্তাহে গেজেট আকারে প্রকাশ হতে পারে বলেও জানান তিনি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সংসদের এই সীমানা নির্ধারণ নিজেদের ইচ্ছামতো করা হতো। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে। এখন আমাদের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত যে আইন আছে, সেখানে একটা ব্যাখ্যাগত ভুলের কারণে এটা নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারছিল না। নির্বাচন কমিশন এই আইন প্রস্তাব করেছে। এখন আমরা এই সংশোধনী করে দিয়েছি। এখন সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে, সেটা তারা ইচ্ছা করলে এই অধ্যাদেশ গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করতে পারবে, দুই চার দিনের মধ্যে।
এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কোড অব সিভিল প্রসিডিওর (সিপিসি) সংশোধনীর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশে সিভিল মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ লাগে। এখানে আমরা অনেক পরিবর্তন এনেছি। এর মধ্যে আগে ইচ্ছামতো শুনানি মুলতবি করা যেত। এখন আর তা করা যাবে না। আদালতে আইনজীবীর লিখিত আর্জি পড়ে শোনানোর ঘটনা বছরের পর বছর চলত।
এখন আইনে সংশোধনীর মধ্যে বলা হয়েছে আদালতে যে লিখিত স্টেটমেন্ট দেবে সেটাই চূড়ান্ত। সেটা মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা লাগবে না। আরেকটা হচ্ছে মামলার রায়ের পর তা কার্যকর করতে আলাদাভাবে আবার মামলা করা লাগতো। সেটাও এখন করতে হবে না। আমরা আশা করি, সিভিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এর আগে আইনটির ৪, ৬ ও ৮ ধারায় অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে সংশোধনী আইনের একটি খসড়াও পাঠানো হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি খসড়া পর্যালোচনা করে।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন ও আগের ৯টি ধারা বাতিল ॥ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, সাইবার সুরক্ষা আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে অনলাইন জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সাইবার স্পেসে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে আগের আইনের ৯টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। এই ৯টি ধারা ছিল কুখ্যাত ধারা, এসব ধারাতেই ৯৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল। মামলাগুলোও এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
তিনি জানান, এছাড়া কিছু কিছু ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি অপরাধ রাখা হয়েছে, একটি হচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ, হুমকি দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো, যেই ঘৃণা ছড়ানোর মধ্যে দিয়ে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়। ধর্মীয় ঘৃণাকে কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে ভুল বুঝাবুঝি না হয়, কেউ কাউকে হয়রানি করতে না পারে। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যদি কোনও সাইবার অপরাধ করা হয়, সেটাকে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই দুটি ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে এটা আমলি আদালতে যাবে, এর পর ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেখেন এই মামলায় কোনো যৌক্তিকতা নাই, তাহলে প্রি ট্রায়াল স্টেজে তিনি মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ চার্জশিটের জন্য অপেক্ষা করা লাগবে না। যদি দেখেন সম্পূর্ণ ভুয়া মামলা, এই মামলার কোনো ভিত্তি নাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন।
আসিফ নজরুল বলেন, বিলুপ্ত করা বিধানগুলোর মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় শহীদ বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার যে দণ্ড দেওয়ার বিধান সেটা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই বিধানে প্রচুর হয়রানিমূলক মামলা হতো।
মানহানিকর তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিধান যেটা এতে প্রচুর মামলা হতো, অনেক সাংবাদিক এই মামলার ভুক্তভোগী হয়েছেন, এই ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। আরেকটা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই ধরনের কোনও কন্টেন্ট বা কথাবার্তা বলায় প্রচুর মামলা হতো, এটাও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আক্রমণাত্মক বা ভীতিকর তথ্য উপাত্ত প্রকাশ এটাও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
অবমাননাকর প্রতিক্রিয়া আশা করি না ॥ ব্রিফিংকালে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছে, নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন একটা কমিশনের প্রস্তাব। এটা তো সরকারি সিদ্ধান্ত না। তিনি বলেন, শুধু নারীর প্রতি না, জাতির প্রতি অবমাননাকরভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা আমরা এটা আশা করি না।
তিনি বলেন, আমাদের যতগুলা সংস্কার কমিশন হয়েছে, সবগুলোর বিষয়ে কিছু না কিছু ভিন্ন মত এসেছে। সুতরাং, নারী সংস্কার কমিশনের যে প্রস্তাব, সেখানে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত শালীনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক আক্রমণাত্মক এবং শুধু নারীর প্রতি না, জাতির প্রতি অবমাননাকরভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা আমরা এটা আশা করি না। এই সমাজে ভিন্ন মতের চর্চা থাকবে।
আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের যেকোনও ধরনের বড় সংস্কার রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া বাস্তবায়ন করা হবে না। এটা কমিশনের প্রস্তাব, সরকারের সিদ্ধান্ত না। আমরা আশা করব, ভিন্ন মত এবং প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সবাই যেন সহনশীলতা এবং শালীনতার পরিচয় দেন।