
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় নাশকতা ও সহিংসতায় হতাহতের ঘটনায় অসংখ্য মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মামলার বাদী জানেন না আসামি কারা, আবার আসামিরাও জানেন না কেন তাঁদের মামলার আসামি করা হয়েছে। কারণ, ঘটনার সময় তাঁরা এর আশপাশে না থাকলেও তাঁদের আসামি করা হয়েছে। আবার কিছু মামলায় বাদীর খোঁজ পর্যন্ত মিলছে না।
গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় এ ধরনের একটি হত্যা মামলা করেছেন আশরাফ আলী নামের এক ব্যক্তি। ওই মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে মৃত আলতাফ হোসেনকে। বাস্তবে যার নাম-ঠিকানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। একইভাবে মামলার বাদী আশরাফ আলীর সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এজাহারে উল্লেখ করা তাঁর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই মামলায় বেশ কজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমানে তাঁরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন ।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলার যেসব আসামি ঘটনার ধারে-কাছেও ছিলেন না কিংবা যে ঘটনাই ঘটেনি অথচ ঢালাওভাবে তাঁদের মামলার আসামি করা হয়েছে, এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। কারণ এ ধরনের মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেশির ভাগ আসামির নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ক্ষমতাচ্যুত সরকার যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার বিচার হতে হবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। বিনা অপরাধে যেন কেউ নির্যাতনের শিকার না হয়, সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢালাওভাবে মামলার আসামি করার পেছনে পাঁচটি কারণ রয়েছে। পূর্বশক্রতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দখল বাণিজ্য, হয়রানি এবং চাঁদাবাজি। একটি চক্র চাঁদাবাজি করতে অনেক মামলায় ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ নানা পেশার মানুষকে আসামি করছে।
আশরাফ আলীর দায়ের করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৮২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, গত ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অভিযুক্তরা গুলি চালালে আলতাফ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। বাদী আশরাফ আলী মৃত আলতাফ হোসেনের ফুপাতো ভাই হিসেবে মামলাটি করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার জাহিদগঞ্জ ইউনিয়নে।
এদিকে বাদী আশরাফ আলীর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। কথা বলতে যতবার ওই নম্বরে ফোন করা হয় প্রতিবার তা বন্ধ পাওয়া যায়। ওই মামলায় ৩৯ নম্বর আসামি করা হয় বেসিসের নির্বাচিত পরিচালক সৈয়দ আব্দুল্লাহ জায়েদকে। অথচ ৪ আগস্ট তিনি দেশেই ছিলেন না। ওই দিন তাঁর দেশের বাইরে অবস্থানের যাবতীয় তথ্য কালের কণ্ঠের কাছে আছে।
মৃত্যু সনদেও জালিয়াতি
মামলার বাদী আশরাফ আলীর দাখিল করা আলতাফ হোসেনের মৃত্যু সনদটি জাল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কারণ রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ ইউনিয়নে রসুলপুর নামে কোনো গ্রাম নেই। মৃতু্যু সনদে আলতাফ হোসেনের গ্রাম রসুলপুর উল্লেখ করা হয়েছে।
জাহানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আব্দুস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ ঘটনাকে জালিয়াতি বলে উল্লেখ করেন। এদিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গত ৪ আগস্টের ডেথ রেজিস্ট্রার অনুসন্ধান করে এ ধরনের কারো নাম পাওয়া যায়নি।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি সদর দপ্তরের ইন্সপেক্টর মো. আনিস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন। শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’ মামলার ভুক্তভোগীর হদিস নেই, বাদীর মোবাইল বন্ধ, এ অবস্থায় তদন্তকাজ কিভাবে করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজশাহী গিয়েছি, সব সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি, তদন্ত চলমান থাকায় এই মুহূতে আর কিছু বলতে পারব না।’
গত বছর ৪ আগস্ট মিরপুর-১০ নম্বরের শাহ আলী প্লাজা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ। ৭ সেপ্টেম্বর ইকরামুলের বাবা মো. জিয়াউল হক বাদী হয়ে ৭৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর মধ্যে চারজন কক্সবাজারের বাসিন্দা। ওই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় আরো ১০০ থেকে ১৫০ জনকে। কক্সবাজারের বাসিন্দা মামলার ৫৪ নম্বর আসামি মিজানুর রহমান মাতব্বর (৫৫), তাঁর চাচাতো ভাই জিয়াউর রহমান (৪৫) ২৯ নম্বর আসামি, ভাতিজা মো. কামাল (৪৩) ৪১ নম্বর আসামি এবং নাজমুল হোছাইন (৩৪) ৬২ নম্বর আসামি।
আসামি মিজানুর রহমান মাতব্বর ও জিয়াউর রহমান জানান, তাঁদের চারজনকে আসামি করা হলেও ঘটনার দিন তাঁরা কেউ ঢাকায় ছিলেন না। সেদিন তাঁরা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ছাত্রদের সমর্থনে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পূর্বশত্রুতার জেরে তাঁদের আসামি করা হয়েছে।
ওই মামলার সাক্ষী তরিকুল ইসলাম বলেন, মামলার রাক্ষী হিসেবে কিভাবে তাঁর নাম এসেছে সেটা তিনি জানেন না।
অন্যদিকে গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন মো. হৃদয় (২০) নামের এক কিশোর। ওই হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় পাঁচ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের একাধিক মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চাঁদা আদায় কিংবা ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ না পেয়ে অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে।
আড়াইহাজার থানার একটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়াকে হত্যার অভিযোগে গত ২২ আগস্ট মামলাটি করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। এতে বলা হয়, ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সচেতন নাগরিক হিসেবে অংশ নেন বাবুল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবুল মিয়াকে কালীবাড়ি বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে দুপ্তারা ঈদগাহ মাঠে হত্যা করা হয়। অথচ স্বজনদের ভাষ্য ও বাবুলের মৃত্যু সনদ অনুযায়ী, তিনি মারা গেছেন ৩ জুন। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপি মহাসচিব শোকবার্তাও পাঠিয়েছিলেন।
ডিএমপির একাধিক থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাদী যখন এজাহার দাখিল করেন সেখানে কাদের নাম আছে, অপরাধী না নিরপরাধ ব্যক্তি, সেটা তো জানা সম্ভব না। তবে তদন্তে সব বেরিয়ে আসে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মামলায় ব্যবসায়ীদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাকে হত্যা মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে একটি চক্র চাঁদা আদায় করে নিয়েছে।’
মাওলানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে আসামি করা হলে মামলার প্রকৃত মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। মামলাগুলো যে পদ্ধতি অনুসরণ করে করা উচিত, সেভাবে হচ্ছে না। প্রকৃত আসামি চিহ্নিত না করে অন্যদের নামে মামলা করা হলে তা সাজানো মামলা হয়ে যাবে।