Image description

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আলোচিত ব্যবসায়ী ও সাবেক বায়রা মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে মেডিক্যাল বাণিজ্যের আড়ালে সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। কর্মী পাঠানোর নামে প্রায় আট লাখ কর্মীর কাছ থেকে মেডিক্যাল ফি বাবদ ৮০০ কোটির বেশি টাকা লোপাট করে স্বপন ও তাঁর সিন্ডিকেট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতাকে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছে। এখন সমন্বিত তদন্ত, দ্রুত বিচার এবং এই চক্রে জড়িতদের কঠোর আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/05. May/06-05-2025/2/kalerkantho-ft-7a.jpgঅনুসন্ধানে দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে গড়ে ওঠা নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য স্বপন। মীম মেডিক্যালক্যাথারসিস মেডিক্যাল নামের দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে হাজার হাজার বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এই সিন্ডিকেটের ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির অন্যতম ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গেই মীম মেডিক্যাল ও ক্যাথারসিস মেডিক্যালের সরাসরি সংযোগ রয়েছে।প্রতিষ্ঠানগুলো রুহুল আমিন স্বপনের ক্যাথারসিস গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার পর স্বল্প সময়েই চার লাখ ৯৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় মেডিক্যাল চেকআপ বাধ্যতামূলক হলেও তা পরিচালনার দায়িত্ব পায় কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বিদেশ গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়া যেকোনো মেডিক্যালেই কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো যায়।

কিন্তু স্বপন সিন্ডিকেটের কারণে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই শুধু মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের মেডিক্যাল করতে পেরেছে। এর মাধ্যমে স্বপন হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। এ টাকার বেশির ভাগই বিভিন্ন চ্যানেলে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মালয়েশিয়া যাত্রায় মেডিক্যাল ফি ১০ হাজার টাকার কমে দিতে পারেননি কোনো কর্মী। এমনকি ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত মেডিক্যাল ফি দিতে হয়েছে কর্মীদের।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত চার লাখ ৯৪ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। আবার সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও ১৮ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। মেডিক্যাল ফির অর্থ আদায়ের হিসাবে দেখা যায়, যেতে পারা এবং না পারা কর্মীদের কাছ থেকে মেডিক্যাল ফি বাবদ ৫০০ কোটির বেশি অর্থ লোপাট করেছে মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি হিসাবে ১৮ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে না পারলেও এর বাইরে আরো তিন লাখ কর্মীর মেডিক্যাল করিয়েছে এই সিন্ডিকেট। যাঁদের কাছ থেকে ১০ হাজার করে ৩০০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। অর্থাৎ এই মেডিক্যাল ফি দ্বারা ৮০০ কোটির বেশি অর্থ লোপাট করে স্বপন সিন্ডিকেট। এই টাকার বড় অংশই চলে গেছে স্বপনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে। স্বপনের মালিকানাধীন মীম মেডিক্যাল ও ক্যাথারসিস মেডিক্যাল নামে কর্মীদের মেডিক্যাল পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাগাভাগি করা হতো।

অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি সেন্টার প্রবাসী কর্মীদের মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াই ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করেছে। এতে করে বিদেশ যাওয়ার পর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন কর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী বলেন, আমার ভাইয়ের মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। পরে সে মালয়েশিয়ায় গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন জানতে পারি মেডিক্যাল রিপোর্ট ছিল ভুয়া।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি ১৭ হাজার ৭৭৭ জন শ্রমিক। কিন্তু বাস্তবে কয়েক লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালালচক্রকে অর্থ প্রদান করেছিলেন। পাশাপাশি বিদেশে যাওয়ার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে মেডিক্যাল টেস্টও সম্পন্ন করেছিল।

ভোগান্তিতে কর্মীরা

পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলার বাসিন্দা রাব্বি হোসেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি মোহাম্মদ নুরুজ্জামান অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের (আরএল-৭০৫) আওতাধীন মেডিক্যাল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান তিনি। দু-দুবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে ২১ হাজার টাকা খরচ করেন রাব্বি হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি দুবার মেডিক্যাল করেছিলাম। দুবার করতে প্রথমবার ১১ হাজার এবং দ্বিতীয়বার ১০ হাজার টাকা করে ২১ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। প্রথমবার মেডিক্যাল করার পর তিন মাসের মধ্যে এজেন্সি ভিসা দিতে পারেনি। এ জন্য মেডিক্যাল সার্টিফিকেটের আর মূল্য থাকেনি। এ জন্য দ্বিতীয়বার মেডিক্যাল করতে হয়েছে। এত মেডিক্যাল করে কী লাভ হলো। এই টাকাও তো আর ফেরত পাব না।

আবুল খায়ের ও আবু কাউসার দুজন সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। মালয়েশিয়ার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে তাঁদের খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। কালের কণ্ঠকে আবু কাউসারের বাবা হানিফ শিকদার বলেন, আমার ছেলে এবং ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য মেডিক্যাল করিয়েছিলাম। ঢাকার পল্টনে একটি মেডিক্যাল সেন্টার থেকে মেডিক্যাল করাই। সেখানে একজনের ১৫ হাজার করে দুজনের জন্য ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। দুই-তিনটা সময় দেওয়ার পর মেডিক্যাল করাতে পারছি। এরপর আবার তাঁদের নাশতা করানোর জন্য টাকা দিতে হয়েছে। আবার তিন হাজার টাকা করে ওষুধ নিতে হয়েছে। এরপর মেডিক্যাল সম্পূর্ণ হয়েছে।

সজীব আহমেদ কামাল নামের মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কালের কণ্ঠকে বলেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য মেডিক্যাল সম্পন্ন করতে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মেডিক্যালের মেয়াদ শেষ হলেও আমাদের বিদেশ পাঠানো হয়নি। পরে আবারও মেডিক্যাল করতে বলা হয়, এর মধ্যেই মালয়েশিয়ার ভিসা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত রিক্রুটিং এজেন্সি এশা ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৫৯৭) পক্ষ থেকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার বাসিন্দা নজরুল সরকার জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে তাঁর ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ঢাকার রামপুরার একটি মেডিক্যাল সেন্টার থেকে তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালয়েশিয়া কর্মীদের মেডিক্যাল করা একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কালের কণ্ঠকে বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী গেলেও ২০ থেকে ২৫ লাখ কর্মীকে মেডিক্যাল টেস্ট করানো হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ কর্মীকে মীম মেডিক্যাল ও ক্যাথারসিস মেডিক্যালে মেডিক্যাল করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বাকি গমনেচ্ছুদের মেডিক্যাল হয়েছে সিন্ডিকেটের নির্ধারিত ৪৭টি মেডিক্যাল সেন্টারে।

তিনি আরো বলেন, অন্যান্য মেডিক্যালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলেও কর্মীপ্রতি তিন হাজার করে স্বপনের অফিসে পৌঁছে দেওয়া লাগত। নতুবা মেডিক্যাল রিপোর্ট ঠিক হয়নিএমন অজুহাতে নতুন করে মেডিক্যাল করতে বাধ্য করা হতো।

মেডিক্যাল ছাড়া হুন্ডি ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত স্বপন

ব্যাংকিং ট্রান্সজেকশন, মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। মূলত স্বপনের মালিকানাধীন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে মীম মেডিক্যাল ও ক্যাথারসিস মেডিক্যালের আর্থিক লেনদেন গভীরভাবে জড়িত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বপনের নামে বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে অন্তত ১২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে গত দুই বছরে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি থেকে অর্জিত ব্যাবসায়িক আয়ের তথ্য গোপন করে রেমিট্যান্স হিসেবে তা দেখিয়ে কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে রুহুল আমিন স্বপনের বিরুদ্ধে। তদন্তে দেখা গেছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইনওয়ার্ড কমার্শিয়াল রেমিট্যান্সের নামে কোটি কোটি টাকা অর্জন করেন তিনি, যা করযোগ্য ব্যাবসায়িক আয় হলেও রিটার্নে তা উল্লেখ করেননি।

স্বপনের মালিকানাধীন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ার রেডউড ফার্নিচার কম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে জনশক্তি পাঠালেও সে বাবদ পাওয়া অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দাবি করে তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন এবং সরকারের কাছ থেকে নগদ প্রণোদনাও নিয়েছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) তদন্তে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল করবর্ষে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে ১৩৯ কোটি টাকা ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১.৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। যার বড় অংশ আয়কর বিবরণীতে নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে রুহুল আমিন স্বপনকে ফোন দেওয়া হলে তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ব্যবস্থা করে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।