
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ করে কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ইজিপি চালু, স্বাধীন নিরক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি পাঠিয়ে সরাসরি পণ্যের প্রচার চালানো বন্ধ করা, মেডিকেল পুলিশ গঠন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস চালু, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করাসহ স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে একগুচ্ছ প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এ কমিশনের সদস্যরা গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো বহুদিনের, এর মাধ্যমে আমরা যদি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারি, তা হবে যুগান্তকারী ঘটনা। একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ডাক্তার সংকট, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার থাকলেও যেখানে দরকার, সেখানে ডাক্তার নেই। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।’ চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটা ছাড়া সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়। চিকিৎসকদের যেখানে পোস্টিং, সেখানে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রতিবেদন পেশ করার সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. নায়লা জামান খান, ডা. মোজাহেরুল হক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী, ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এম এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম, ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি উমায়ের আফিফ। পরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে তারা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘অতি দরিদ্র মানুষ সব ধরনের সেবা বিনামূল্যে পাবে। ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগী বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পাবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং ওষুধের তালিকা প্রতি দুই বছর পর হালনাগাদ করতে হবে। ক্যানসার, ডায়বেটিসের ওষুধের ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। জরুরি ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো ও দুই বছর পর পর সেই তালিকা হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। শুরুতে ২৫ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে লিখতে হবে, পাঁচ বছরের মধ্যে সব ওষুধ জেনেরিক নামে লিখতে হবে। কমিশন বলেছে, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের কাছে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন না। কেবল চিকিৎসকদের ই-মেইলে বা ডাকযোগে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবেন। কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন বলেন, ‘ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ নামে একটি স্বতন্ত্র কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সেজন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন এবং জনবল কাঠামো পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য উচ্চপর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস প্রধান ও উপপ্রধান, মহাপরিচালক, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, বিএমডিসি ও বিএমআরসি চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা সম্পর্কে জাতীয় সংসদকে অবহিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা বিভাগ পৃথককরণ, জনবল নিয়োগ ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, নতুন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগেই প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা, বাজেট বরাদ্দ ও দালাল দমন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠন, ফিজিওথেরাপি বিভাগ ও পদ সৃষ্টি এবং গ্রামপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সহিংসতা রোধে ‘মেডিকেল পুলিশ’ নামে প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করতে হবে, যা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য মেডিকেল প্রফেশনাল ইন্স্যুরেন্স চালু করতে হবে। এমবিবিএস বা বিডিএস ব্যতীত কেউ ‘চিকিৎসক’ পরিচয়ে রোগী দেখলে, বিএমডিসি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে কিছু নতুন আইন করার কথা বলা হয়েছে। আইনগুলো হলো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন; হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক অ্যাক্রিডিটেশন আইন; বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিকেল ডিভাইস আইন। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি কপোরেশন আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৫১টি বৈঠক করেছেন। কমিশন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল এবং ঢাকায় ৩২টি পরামর্শ সভা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের মাধ্যমে ৮ হাজার ২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে।