
সরকারি কোয়ার্টার নিয়ে অবাধে চলছে ভাড়া বাণিজ্য। নিজেদের নামে কোয়ার্টার বরাদ্দ নিয়ে উচ্চমূল্যে বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ বিষয়ে তদারকি সংস্থা সরকারি আবাসন পরিদফতরের কাছে জানতে চাইলে মেলেনি সদুত্তর। এদিকে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সাবলেট বা ভাড়া দেয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ নগর পরিকল্পনাবিদদের।
চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল আবাসন থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল বহুতল কোয়ার্টার নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু এ সব কোয়ার্টারে কারা কীভাবে থাকেন সেটি জানতে মাঠে নামে সময় সংবাদ।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, আজিমপুর জোন বি। মূল ফটকের সামনে যেতেই চোখে পড়ে অসংখ্য বাড়ি ভাড়ার নোটিশ। শুধু সরকারি চাকুরেদের থাকার কথা থাকলেও এক রুম, সিঙ্গেল সিট, এমনকি ছোট পরিবার নিয়ে বহিরাগতদের থাকার সুযোগের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে আছে এসব দেয়াল। রুম ভাড়া নেয়ার কথা বলে একটি নম্বরে ফোন দিলে বলা হয়, কোয়ার্টারের ভেতরে নীচ তলায় রুম পাওয়া যাবে।
তার দেয়া নির্দেশনা মোতাবেক এই কোয়ার্টারেরই ১৩ নম্বর ভবনে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ তাদের সবাই সরকারি চাকুরি করে। কেউ পুলিশ, কেউ ডাক্তার, কেউ নার্স, কেউ আবার শিক্ষক।
এবার সেই নম্বরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক কর্মকর্তার আত্মীয়। তিনি জানান, তিন বেডরুমের এই ফ্ল্যাটের এক রুম ভাড়া দিয়ে রেখেছেন গত এক বছর ধরে, আরেকটি রুমের জন্য খুঁজছেন ভাড়াটিয়া। সবকিছু মিলিয়ে ভাড়া পড়বে ১১ হাজার টাকা। ফ্ল্যাট আমার ভাইয়ের, উনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আছেন।
বাসা দেখে বের হতেই দেখা নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। এবারের অফার আরও লোভনীয়, সিঙ্গেল সিট নাকি রুম যেমনটি চাই তারই ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন বলে নিশ্চয়তা দিলেন। তিনি বলেন, আমার নম্বর নিয়ে যান। যেমন রুম চান, সেটিই ব্যবস্থা করে দিব।
সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপত্তাকর্মী পাঠালেন আরেকটি ফ্ল্যাট দেখতে, যেখানে রয়েছে সিঙ্গেল সিটে থাকারও সুযোগ। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জানান, ‘বিছানা আমাদেরই থাকবে। ভাড়াটিয়া শুধু তার জামা-কাপড় ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে এসে উঠতে পারবেন।’
এবার গন্তব্য পলাশী সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার। এখানের একটি বাসা যার নামে বরাদ্দ সেই শিক্ষিকার দেয়া লোকেশনে গিয়ে দেখা যায়, ৩ রুমের ফ্ল্যাটের দুই রুম ভাড়া দেয়া হবে। রুম ভাড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, যত জন ইচ্ছা থাকা যাবে, ভাড়া ১২ হাজার।
সরকারি আবাসন বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসায় সাবলেট দেয়ার বিধান না থাকলেও এসব কোয়ার্টারের অধিকাংশ ফ্ল্যাটেই এক থেকে দুই রুম সাবলেট কিংবা মেস হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা।
এ বিষয়ে সরকারি আবাসন পরিদফতরের বক্তব্য কি সেটি জানার জন্য পরিচালককে না পেয়ে অতিরিক্ত পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই তার। পরামর্শ দেন পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের।
সরকারি আবাসন পরিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক আবু জাফর রাশেদ মুঠোফোনে সময় সংবাদকে বলেন, যে বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন সে বিষয়ে আমি খুব ভালো বলতে পারব। তবে অফিসিয়াল কিছু নিয়ম আছে। আমার অফিস প্রধান হচ্ছেন যুগ্মসচিব, পরিচালক। উনি এই বিষয়ে কথা বলবেন।
তবে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কয়েক দফা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি পরিচালককে।
আবাসন পেয়েও বাড়তি লাভের আশায় নিয়ম ভেঙে বছরের পর বছর ধরে বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেয়ার এই অনিয়মকে এক প্রকার নিয়মে পরিণত করেছেন সরকারি চাকুরিজীবীদের একটি অংশ, যাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ নগর পরিকল্পনাবিদের।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এটি একটি ওপেন সিক্রেট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সাবলেট বা ভাড়া দেয়ার সুযোগ নেই। সরকার যদি কর্মকর্তাদের নীতিমালা না মানাতে পারে, তাহলে বড় একটি সংকট তৈরি হবে।
সরকারি কোয়ার্টারে ভাড়া বাণিজ্য সম্পর্কে অবহিত থাকলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।