
রবিউল ইসলাম। পেশায় একজন অটোচালক। গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীতে। টানাপড়েনের সংসার তার। এই অভাব-অনটনের মধ্যে আবার ঘিরে ধরেছে জুয়ার আসক্তি। দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকে পড়েছেন অনলাইন জুয়ায়। তার এক বন্ধুর পরামর্শে অনলাইন জুয়া বাবু ৮৮ সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলেন। এই আসক্তি থেকে চাইলেই তিনি পারছেন না বের হতে। লাভের আশায় হারাচ্ছেন অর্থ। রবিউল মানবজমিনকে বলেন, আমি আমার এক বন্ধুর পরামর্শে একদিন জুয়ার সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলি। তখন আমি হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করতাম। এটা অনেকটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। শুরুতে একবার ৫০ হাজারেরও বেশি টাকা আমার আয় হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এখানে আমার আয়ের চেয়ে লোকসানই বেশি হওয়া শুরু হয়। কিছুদিন লাভ হতো আর এটা থেকেই আমার আসক্তি তৈরি হয়।
শুধু রবিউল নন, অনলাইন জুয়ার এই সাইটগুলোতে তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক থেকে শুরু করে অসংখ্য বেকার যুবকরা ঝুঁকে পড়েছেন। হকার, দোকানি, দিনমজুর, বাস-ট্রাকের চালক, নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষ বুঁদ হয়ে থাকছে এই নেশায়। অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে অনলাইনে বাজি ধরতে। জুয়ার টাকা যোগাতে কেউ কেউ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনলাইন জুয়ার আসরে। আবার কোনো কোনো সংসারে ফাটল ধরছে জুয়ার এই ভয়াবহ আসক্তির ফলে। অনলাইনে জুয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে অধিক আয়ের আশায় ঝুঁকছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা করে জুয়া খেলতে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। দিন দিন অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি অনলাইন জুয়া বন্ধে সাত দপ্তরের সাত কর্মকর্তাকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, বিএফআইইউ ও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এসব সদস্য নিতে হবে। ২৭শে এপ্রিল এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর আদালত এ আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট, লিংক ও গেটওয়েগুলো কারা কীভাবে চালায়, তা এ কমিটি চিহ্নিত করবে। কমিটি প্রয়োজনে আরও বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য কমিটি সময় পাবে ৯০ দিন। রিট আবেদন করেন তানজিম রাফিদ নামের এক ব্যক্তি।
এদিকে, গতকাল অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল প্রকার ইন্টারনেট গেটওয়ে, লিংক, অ্যাপ্লিকেশন এবং বিজ্ঞাপন ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, বিগোলাইভ, টিকটক, লাইকি, গুগল প্লে-স্টোরসহ সকল ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম থেকে অপসারণের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে অনলাইন জুয়া বন্ধে এবং জড়িতদের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। বিচারপতি কাজী জিনাত হক এবং বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, কোন কোন জেলা বা গ্রামে অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে তরুণরা এই অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই জুয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। অর্থ লোভ, এটি তাদেরকে বুঝানো হয় যে এর সঙ্গে যুক্ত হলে সে যত টাকা দিয়ে অংশ নেবে তার চেয়ে বেশি টাকা সে পাবে। চটকদার লোভনীয় বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে মানুষকে প্রলোভন দেখানো হয়। অনলাইন জুয়া যারা পরিচালনা করে তারা প্রথমদিকে যারা যুক্ত হয় তাদের প্রলোভন দিয়ে অর্থ ফাঁদের মধ্যে ফেলে দেয়। প্রথম দিকে তাকে কৌশলী হয়ে বেশি টাকা দিয়ে ফাঁদে ফেলে। যাতে পরবর্তীতে সে টাকা দিতে আগ্রহী থাকে। অনেকে আবার অবসর সময় কাটাতে এই জুয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। পরিচালনাকারী চক্রের উদ্দেশ্য থাকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে নৈতিকভাবে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাওয়া।