Image description

প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কঠোর হস্তে দমাতে বিদ্যমান সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ সংশোধন করছে  অন্তর্বর্তী সরকার। চাকরি আইনে ছয় বছর আগে বাতিল হওয়া সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯ থেকে কয়েকটি ধারা যোগ করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনটি কার্যকর হলে দাপ্তরিক বা প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কর্মচারীকে তদন্ত ছাড়াই এক সপ্তাহের নোটিশে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। প্রস্তাবিত এই ধারাগুলোকে প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা কালো ধারা বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মতে, এতে করে প্রশাসনে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়তে পারে।

বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন এটি সরকারের এখতিয়ার।

জানা গেছে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব, অনুমতি ছাড়াই কিছু কর্মচারীর কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, ডিসি নিয়োগকাণ্ডে হট্টগোল-হাতাহাতি, সচিবের রুম আটকে আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার এ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।প্রথমে বাতিল হওয়া সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিদ্যমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মাঝে নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে এবং কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনসংগত আদেশ/নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

যার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পাদনে শৈথিল্য প্রদর্শিত হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, আনুগত্য প্রতিষ্ঠা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহতকরণ এবং দ্রুত আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের ব্যবস্থা হিসেবে রহিতকৃত সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ পুনরায় কার্যকর করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় রহিতকৃত সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

বিষয়টি নিয়ে গত ১২ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আসছে বিশেষ বিধান শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হলে তোলপাড় শুরু হয় প্রশাসনে। এর পরই বাতিল হওয়া সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯-এর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী আইনে সংযোজন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা জানিয়েছে, ২০১৮ সালে বাতিল হয়ে যাওয়া সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯-তে যা ছিল, সরকারি কর্মচারী আইনে তা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের খসড়াটি প্রধান উপদেষ্টার সম্মতিসাপেক্ষে শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হবে।

খসড়ায় যা আছে : সংশোধনের প্রস্তাবিত খসড়ায় তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, (ক) চাকরি থেকে বরখাস্ত, (খ) চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং (গ) পদাবনতি বা বেতন কমিয়ে দেওয়া। প্রথমত, কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে যুক্ত থাকেন যাতে অন্য কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় বা শৃঙ্খলা নষ্ট হয় বা অন্য কোনো কর্মচারীর কাজ করতে সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কর্মচারী ছুটি বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা অন্য যেকোনোভাবে কাজ থেকে বিরত থাকেন। তৃতীয়ত, অন্য কোনো কর্মচারীকে কাজ থেকে বিরত থাকতে প্ররোচনা দেওয়া বা অন্য কোনো উপায়ে কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চেষ্টা করা। চতুর্থত, অন্য কোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্মস্থলে উপস্থিত হতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া। উল্লিখিত যেকোনো বিষয়ে দোষী কর্মচারীকে শাস্তি দিতে পারবে সরকার।

প্রস্তাবিত খসড়ায় অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের মধ্যে অভিযোগের জবাব বা ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে হবে। উল্লিখিত সময়ে অভিযোগের জবাব না দিলে বা জবাব দেওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপ করে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেবে। এরপর জবাব না দিলে বা জবাব দিলেও তা কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক না হলে অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর চূড়ান্তভাবে শাস্তি আরোপ করা হবে। তবে শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর সাত দিনের মধ্যে বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বরাবর ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাস্তির বিপরীতে আপিলের ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না’—এমন বিধান ছিল। কিন্তু সরকারি কর্মচারী আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় এটি রাখা হচ্ছে না। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে আপিলের মাধ্যমে পাওয়া সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

প্রশাসনে আতঙ্ক : প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এই উদ্যোগে প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী আতঙ্কিত। গত সরকারের সময়েও তাঁরা নিয়ম মেনে কাজ করেছেন। এখনো করছেন। কিছু কর্মকর্তার দলবাজির কারণে অনেক নিরপরাধ কর্মকর্তার চাকরি যাচ্ছে বা যাবে। বিশেষ করে যাঁরা গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন, মাঠ প্রশাসনে কাজ করেছেন, তাঁদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে চলছে তোলপাড়।

এক কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে জানান, সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। ১৯৭৯ সালের বিশেষ আইনটি যখন হয়েছিল তখন সংবিধান স্থগিত ছিল।

যা বললেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা : এ ব্যাপারে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, রহিত অধ্যাদেশটি ছিল একটি কালো আইন। এর ধারা বহাল হলে তা হবে আত্মঘাতী। সরকারি চাকরি থেকে কাউকে বাধ্যতামূলকভাবে বের করে দেওয়া, বরখাস্ত করাসবই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। মানবাধিকার ও সংবিধানবিরোধী। ২৫ বছর পর চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে মুয়ীদ কমিশনের প্রতিবেদনেও। এটি করা হলে প্রশাসনে চাকরি হারানোর আতঙ্ক দেখা দেবে, প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়বে।

প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন, যদিও এটি কালো আইন, কিন্তু বর্তমান প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরাতে এটির প্রয়োজন আছে। তবে সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন আইনটির অপব্যবহার না হয়।

সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এমন আইন থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মচারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে আন্দোলনের নামে যে বিশৃঙ্খলা দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন। জনপ্রশাসনের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার জন্য প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরছে না। তাই সরকার হয়তো অন্য কোনো উপায় না দেখে এই নিবর্তনমূলক আইন ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে।