
পদ্মার উজানে ভারতের গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। এ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান এবং ভাটিতে অবস্থিত দেশটির কিছু অংশে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সোচ্চার ছিলেন খোদ ভারতীয় অনেক বিশেষজ্ঞ ও অববাহিকার বাসিন্দারা। এমনকি ব্যারাজটি অপসারণের দাবিও উঠেছিল। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে, সেসব আপত্তি বিশেষ ধোপে টেকেনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের এক শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও।
কপিলের মৃত্যুর ২৭ বছর পর ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকারও ফারাক্কা বাঁধ ‘তুলে দেওয়ার জন্য’ কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়। তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে, অতএব বাঁধটাই তুলে দেওয়া হোক।
নীতিশ কুমার তখন প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গঙ্গায় খুব বেশি পলি পড়ছে বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে, তখন থেকেই এ অবস্থা। নইলে আগে নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেকটা পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যেত, সমুদ্রে গিয়ে মিশত। ১০-১২ বছর ধরে ফারাক্কার ‘প্যাটার্ন’ স্টাডি করেই এ মন্তব্য করছেন, তখন এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
নীতিশ কুমার আজও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তবে যে কোনো কারণেই হোক ফারাক্কা বিরোধিতার সুর তিনি অনেক স্তিমিত করে ফেলেছেন। এ মুহূর্তে তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্গীও। তবে ফারাক্কার উজানে ঝাড়খণ্ড-বিহার সীমান্ত এলাকায় আমজনতারও এই বাঁধকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ- বর্ষাতে যেমন, তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও।
বিহারের আহমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ শেখ বলেন, বর্ষার সময় ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া উচিত, নইলে বিহারবাসীর খুব দুর্দশা হয়। অথচ বর্ষার সময়ই গেট বন্ধ রাখে, নদী ওভারফ্লো করলে তখনই গিয়ে গেট খোলে, যখন বিহার ডুবে যায়। বর্ষা মৌসুম এলেই যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে বিহার একটু স্বস্তি পাবে।
ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায়, গঙ্গাতীরের লাধোপাড়া গ্রামের মিশির শেখ বলেন, রাজমহলের ওপারে গঙ্গা যদি দেখেন, গরমে নদী তো একদম শুকিয়ে যায়। ছোট একটা নালার মতো গঙ্গা বইতে থাকে, বাকি পুরোটা শুকিয়ে যায়। এখন সব পানি (বাংলাদেশে) ছেড়ে দিলে কোনো ফসলই হবে না, কৃষক তো না খেয়ে মরবে।
ফারাক্কা অঞ্চলে বাঁধের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে তারও মিশ্র অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, ফারাক্কায় নদীর বুকেও চর পড়েছে, মাঝ নদীতে বক দাঁড়িয়ে আছে- এটাও যেমন দেখেছি, তেমনি গঙ্গার বিধ্বংসী ভাঙনে পারের মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যেতেও দেখেছি।
এমনকি ফারাক্কাতে তার শেষ ফিল্ড স্টাডিতে স্থানীয় গ্রামবাসী বাঁধকে তুলনা করেছিল একটা সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে। এমনিভাবে দেখাল যে, একটা সাপ রয়েছে, তার মুখটা আপনি চেপে ধরলেন, মানে মাথাটা। তাহলে সে তো দেখবেন ছটফট করছে বেরোনোর জন্য।
ফারাক্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবার জানাচ্ছেন, নদীর ভাঙন ঠেকাতে না পারলে ফারাক্কা অচিরেই তাদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে।
ফারাক্কা আসনের এমএলএ (বিধায়ক) মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, এই বাঁধের জন্য আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাটা অবশ্যই ভালো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন এটা তৈরি করেছে ঠিক, কিন্তু গঙ্গার ড্রেজিংটা করে দিলে আমরা বিপদমুক্ত হব। এই ড্রেজিং না করলে আগামী ৫০ বছর বলছেন কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নদীতে চলে যাব। তো আমাদের কাছে ব্যারাজ একরকম অভিশাপের কারণ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে।
তবে ফারাক্কা নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক থাকলেও বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কাজ কিন্তু বিশেষ এগোয়নি। ফারাক্কা বাঁধ ‘ডিকমিশন’ করতে নীতিশ কুমার প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কিন্তু একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করেছিল, যাতে কেন্দ্রের তরফে পাঁচজন আর বিহার সরকারের তরফে পাঁচজন সদস্য ছিলেন।
সে কমিটিতে বিহারের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন দেশের সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিমাংশু ঠক্কর। তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ফারাক্কা বিহারের ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে- তা নিরূপণ করা। কিন্তু ফারাক্কা হওয়ার আগে ও পরে নদীতে ড্রেনেজ কনজেকশন কী, বন্যার তীব্রতা ও কত ঘন ঘন বন্যা হয়েছে, নদীর ধারণক্ষমতা কত, সেসব ব্যাপারে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন আমাদের কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি, তাই আমরাও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’
তবে ফারাক্কার ‘বিরূপ প্রভাব’ যে গোটা এলাকায় পড়েছে, তাতে হিমাংশুর কোনো সন্দেহ নেই। নীতিশ কুমারের প্রস্তাবেও যথেষ্ট যুক্তি ছিল বলে তিনি মনে করেন।
আগামী ৫০ বছরে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ কী
ফারাক্কা থেকে টানা ফিডার ক্যানেলে শুষ্ক মৌসুমে কতটা পানি টানা যাবে, আর মূল নদী দিয়ে পদ্মায় কতটা পানি ছাড়া হবে- ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গাচুক্তির মূল কথা কিন্তু সেটাই। এখনকার চুক্তি বলছে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে– এই শুষ্ক মৌসুমের সময়টায় প্রথম ১০ দিন ক্যানেল আর পরের ১০ দিন করে পদ্মা অন্তত ৩৫ হাজার কিউসেক পরিমাণ পানি পাবেই। এই পানির প্রবাহ ঠিকঠাক যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ব্যারাজ থেকে কয়েকশ মিটার দূরে ভাটির দিকে মনিটরিং স্টেশনও আছে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা একসঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন। ঠিক একই ধরনের যৌথ মনিটরিং স্টেশন আছে বাংলাদেশের দিকে পদ্মার ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছেও। এখন ২০২৬ সালে কোন শর্তে সেই গঙ্গা চুক্তির নবায়ন হয় বা আদৌ হয় কি না, যথারীতি তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।
হিমাংশু বলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও সারা দুনিয়াজুড়ে অজস্র বাঁধের ডিকমিশনিং হচ্ছে; শুধু আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে দুই সহস্রাধিক বাঁধ ডিকমিশন করা হয়েছে, ইউরোপেও হয়েছে শত শত। তবে এটাও ঠিক, গঙ্গার মতো বিশাল এক নদীতে কোনো ড্যাম ডিকমিশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন নেই। তারপরও কাজটা খুবই সম্ভব আর নানাভাবেই এই ডিকমিশনিং করা যায়।
তিনি আরো বলেন, এখানে তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং’-এর, অর্থাৎ ব্যারাজের ওপরে ট্রান্সপোর্ট লিংকটা রেখে গেটগুলো সব খুলে রাখার বা তুলে দেওয়ার, যাতে রেল ও সড়ক সংযোগ রেখেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেওয়া যায়। পাশাপাশি ক্যানেলটা এখন যে সুবিধাগুলো দিচ্ছে, সেটা কীভাবে বজায় রাখা যায়- তাও দেখতে হবে। এতে ড্যামের মূল কাঠামোটা অক্ষত রেখেও ফারাক্কার অপারেশনাল ডিকমিশনিং করা যাবে।
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপাণ্ডে বলেন, এটা তো শুধু একটা ডাইভারশন বা পানি টানার প্রকল্প, এখানে কিন্তু তেমন স্টোরেজ বা জলাধার কিছু নেই। স্টোরেজ প্রকল্পগুলোর আয়ু হয়তো শতবছর হয়, কারণ পলি পড়ে তার ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। ফারাক্কায় সে সমস্যা নেই, ফলে এটা অনায়াসে ১০০ বছরেরও বেশি টিকতে পারে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ফিডার ক্যানেলের বেড (খাত) আর দুই পাড়ের ক্ষয় ও ভাঙন একটা বড় সমস্যা, যেটা হয়তো ‘ক্রস রেগুলেটর’-এর মতো কিছু বসিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।