
ইসলামের ইতিহাসে যে কারবালা যুদ্ধের অপরিসীম গুরুত্ব, জনশ্রুতি বলে ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দ বা হিজরি ৬১ সনের সেই যুদ্ধে মহানবী হজরত মুহাম্মদের (স.) দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতের এক হিন্দু সারস্বত ব্রাহ্মণ– যার নাম রিহাব সিধ দত। শুধু নিজে যুদ্ধ করাই নয়, তার সাত পুত্রও নাকি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সেই যুদ্ধে আত্মবলি দেন। খবর বিবিসি বাংলার।
প্রায় ১৪০ বছর আগে লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে কারবালার যুদ্ধকে বাংলা সাহিত্যেও অমর করে গেছেন মীর মোশাররফ হোসেইন।
ইতিহাস আর কল্পনা মেশানো সেই কাহিনিতে রিহাব সিধ দতের উল্লেখ না থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে আজও বহু মানুষ আছেন যারা সেই বিবরণে সম্পূর্ণ আস্থা রাখেন এবং নিজেদের সেই ব্রাহ্মণ বীরের বংশধর বলেই পরিচয় দেন।
রিহাব সিধ দতের সেই ‘উত্তরসূরী’রা আজ শত শত বছর পরেও ইমাম হোসাইনের প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা পড়ে আছেন– যে কারণে তারা নিজেদের ধর্ম না পাল্টালেও শিয়া ইসলামের অনেক রীতিনীতি, বিশেষ করে মহররম মাসে আশুরা পালন করে চলেছেন আজও।
ইমাম হোসাইনের অনুগত, অথচ ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু ব্রাহ্মণ- এই অনন্য সম্প্রদায়ই ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত। ভারতের কোনো কোনো জায়গায় তাদের ‘মোহিয়াল ব্রাহ্মণ’ নামেও ডাকা হয়।
ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে এক বিরল সেতুবন্ধ রচনার কারণেই হুসাইনি ব্রাহ্মণরা ভারতের সমাজজীবনে একটি অসাধারণ জায়গা অধিকার করে আছেন। সংখ্যায় তারা কম হতে পারেন, কিন্তু স্বকীয়তায় ও ধর্মীয় সম্প্রীতিতে এক উজ্জ্বল জনগোষ্ঠী!
পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ, ভারতের পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কাশ্মীর, দিল্লি ও লখনৌর নানা প্রান্তে এখনো বেশ কয়েক হাজার হুসাইনি ব্রাহ্মণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করেন। কোনো কোনো গবেষক জানাচ্ছেন, আরব উপদ্বীপেও বেশ কিছু হুসাইনি ব্রাহ্মণ আছেন।
কারবালার যুদ্ধে রিহাব সিং দত ও তার পুত্রদের বীরত্বকে স্মরণ করে প্রাচীন হিন্দুস্তানি কবি লিখে গেছেন –
‘ওয়াহ্ দত সুলতান
হিন্দু কা ধরম
মুসলমান কা ইমান
আধা হিন্দু, আধা মুসলমান’!
সেই পরম্পরা অনুসরণ করেই আজও ভারতে হুসাইনি ব্রাহ্মণরা তাদের জীবনচর্যায় হিন্দু ও মুসলিম – দুই ধর্মেরই কিছু কিছু রীতি রেওয়াজ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে থাকেন।
আজও সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরের আশুরা পালনে মহররমের তাজিয়াতেও যোগ দেবেন তাদের অনেকেই।
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রয়াত বলিউড অভিনেতা সুনীল দত ছিলেন একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ। তার অভিনেত্রী স্ত্রী নার্গিস দত-ও ছিলেন ‘হাফ-মোহিয়াল’। তাদের সন্তানরা, তারকা অভিনেতা সঞ্জয় দত ও রাজনীতিবিদ প্রিয়া দত-ও পারিবারিক সূত্রে একই সম্প্রদায়ভুক্ত।
এছাড়াও হিন্দি-উর্দু ভাষার সাহিত্যিক সাবির দত, আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট নেত্রপ্রকাশ ভোগ, সুপরিচিত সাংবাদিক বরখা দত, ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী সুনীতা ঝিংরান – ভারতের হুসেইনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এরকম বহু সেলেব্রিটি আছেন যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। ‘মোহিয়াল’-রা হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে যোদ্ধার জাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন, আজও তাদের বংশধররা অনেকে আর্মিতে যোগ দিয়ে থাকেন। ফলে আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অনেক হুসাইনি ব্রাহ্মণ আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ইমাম হোসাইনের হয়ে তাদের পূর্বসূরীরা যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কেন? এ ব্যাপারে গবেষক ও ইতিহাসবিদরাই বা কী বলছেন? আর আজ এত বছর বাদেও হুসেইনি ব্রাহ্মণরা কীভাবে ধরে রেখেছেন তাদের অতি গর্বের একটি ইসলামী পরম্পরা?
‘মোহিয়াল’দের ইতিহাস কী বলে?
ইন্দো-ইসলামিক স্কলার গুলাম রসুল দেহলভির মতে, হুসাইনি ব্রাহ্মণরা হলেন প্রাচীন ভারত ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের এক ‘অতুলনীয় নিদর্শন’।
দেহলভি বিবিসিকে বলছিলেন, স্বৈরাচারী ইয়াজিদ যখন ইমাম হোসাইনকে কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে মেরে ফেলার চক্রান্ত করলেন, তখন তিনি বিশ্ব মানবতার উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘হাল মিন নাসিরিন ইয়ানসুরনা!’ – যার অর্থ কেউ কি কোথাও আছে, যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে?
সেই ডাকে সাড়া দিলেন সুদূর ভারতের (হিন্দুস্তান) রাজা সমুদ্রগুপ্ত, যিনি ইমাম হোসাইনের পুত্র আলি আকবরের কাছ থেকেও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে পাঠানো একটি বার্তা পেয়েছিলেন।
ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর পানি আটকে দিয়ে ইয়াজিদের সেনারা ততক্ষণে ইমাম হোসাইন ও তার সঙ্গীদের মৃত্যুর পথ তৈরি করে ফেলেছেন।
এদিকে রাজা সমুদ্রগুপ্ত তার বীর সৈন্যদের একটি দলকে কারবালায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন বীর যোদ্ধা রিহাব সিধ দত – যিনি পাঞ্জাবের একজন মোহিয়াল ব্রাহ্মণ।
গুলাম রসুল দেহলভির কথায়, কিন্তু দত ও তার সাহসী সেনারা যখন কারবালায় পৌঁছলেন, ততক্ষণে ইমাম হোসাইন শহীদ হয়েছেন। ক্ষোভে-দু:খে ভারত থেকে যাওয়া ওই সৈন্যরা স্থির করলেন নিজেদের তরবারি দিয়েই তারা নিজেদের শিরশ্ছেদ করবেন। কিন্তু ইমামের আরব অনুরাগীরা তাদের বোঝালেন, এভাবে জীবন নষ্ট না করে তারা বরং জনাব-ই-মুখতারের বাহিনীতে যোগদান করুন এবং ইমামের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার লড়াইতে সামিল হোন!
রিহাব দত ও তার বাহিনী ঠিক সেটাই করেছিলেন – ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন।
পরে বাহিনীর যারা বেঁচে যান, তাদের কেউ কেউ সেখানেই রয়ে যান – কেউ আবার মাতৃভূমি ভারতে ফিরে আসেন। কারবালার যে অংশটিতে এই বীর ব্রাহ্মণরা বসতি করেছিলেন সেটি পরিচিত ছিল ‘আদ-দায়ার-উল-হিন্দিয়া’ নামে, জানাচ্ছেন গুলাম রসুল দেহলভি।
আরবে আগে থেকেই ছিলেন হিন্দুরা?
হিন্দি সাহিত্যের বিখ্যাত কথাকার মুন্সী প্রেমচন্দও তার ১৯২৪ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত নাটক ‘কারবালা’তে রিহাব সিধ দতের সাহসিকতার কথা লিখে গেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, ইমাম হোসাইনের সমর্থনে ভারত থেকে যাওয়া ‘সাতজন যোদ্ধা’র অসমসাহসী বীরত্বের কথা কারবালার লোকগাথার অংশ হয়ে উঠেছিল।
তবে এই হিন্দু ব্রাহ্মণরা ভারত থেকে কারবালার যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন, না কি আরবে আগে থেকেই ছিলেন এটা নিয়েও নানারকম মত আছে।
গবেষক শিশির কুমার মিত্র-র আকরগ্রন্থ ‘দ্য ভিশন অব ইন্ডিয়া’তে জানানো হয়েছে, ‘আরাবিয়া’ বা আরব পেনিনসুলাতে একটা বিরাট সংখ্যক হিন্দু কারবালা যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বসবাস করতেন।
তিনি আরও লিখেছেন, আফগানিস্তানেও টানা ১২০ বছর ধরে (৮৩০ – ৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ) একটি হিন্দু 'দত' রাজবংশের শাসন কায়েম ছিল – যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সোমানন্দ দত। তবে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা কারবালা যুদ্ধেরও দেড়শো বছর পরের কথা।
১৯৮৬তে ‘দ্য হিস্ট্রি অব মোহিয়ালস’ নামে আর একটি বই লেখেন ইতিহাসবিদ পি এন বালি, যিনি নিজেই ছিলেন একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ।
তিনি দাবি করেছেন, হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের চরিত্র অশ্বত্থামা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তার পিতা দ্রোণাচার্যের করুণ মৃত্যুর পর উদাস হয়ে ঘুরতে ঘুরতে না কি আরাবিয়াতে চলে আসেন– এবং সেখানেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে দিন কাটাতে থাকেন।
এই অশ্বত্থামার বংশধরদের সূত্র ধরেই আরবে হিন্দুদের বসতি, আর তারাই পরে ইমাম হোসাইনের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন– এমনও মতবাদ প্রচলিত আছে।
পাকিস্তানের সুপিরিচিত শিয়া পন্ডিত মৌলানা হাসান জাফর নকভি আবার মনে করেন, কারবালার যুদ্ধ নিয়ে যেমন অনেক ধরনের বিবরণ পাওয়া যায় তেমনি হুসাইনি ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি নিয়েও আসলে একাধিক ‘ভার্সন’ আছে।
বছরকয়েক আগে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটিতে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের নিয়ে করা একটি প্রোজেক্টের গবেষকদের তিনি বলেছিলেন, ইমাম হোসাইনের আহ্বানে রাজস্থান (যেটা তখন সিন্ধ প্রদেশের অংশ ছিল) থেকে হিন্দু রাজা কারবালায় যুদ্ধ করতে গেলেও তিনি পৌঁছানোর আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় – আর রাজা কারবালাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
সঠিক ইতিহাস নিয়ে আজ অস্পষ্টতা আছে অবশ্যই– কিন্তু কারবালায় যাওয়া সেই হিন্দু ব্রাহ্মণদের বংশধররা যে আজও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালবাসাতেই হিন্দু হয়েও বহু মুসলিম রীতিনীতি পালন করে যাচ্ছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘শিয়া মজলিসেও যেতাম, পালন করতাম নবরাত্রিও’
সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ কে কে বালি থাকেন লখনৌর হুসাইনাবাদ রোডে, যে রাস্তাটি প্রাচীন এই নবাবি শহরের বড়া ও ছোটা ইমামবড়াকে কানেক্ট করেছে। মি বালি নিজে একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ।
টেলিফোনে কে কে বালি বলছিলেন, ‘আমার বাড়ির সামনের এই রাস্তা দিয়েই প্রতি বছর মহররমের জলুস যায়। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমি নিজেও সেই জলুসে অংশ নিয়েছি, এখন আর বয়সের জন্য পারি না।’
তবে তিনতলা বাড়ির জানালা থেকেই তার চোখে পড়ে মহররমের ব্যানার-ফেস্টুন, সেগুলো দেখেই এখন সাধ মেটান তিনি।
ছোটবেলা থেকেই কে কে বালি-র আর একটা শখ ছিল, ইমাম হোসাইনকে নিয়ে যেখানে যত কবিতা বা পংক্তি লেখা পেতেন – সেগুলো ভাল লাগলেই নিজের নোটবুকে সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিতেন। এখনো তার সেই অভ্যাস বজায় আছে।
বিবিসিকে তিনি আরও জানাচ্ছিলেন, হুসাইনি ব্রাহ্মণরা যে একটি গর্বিত বীর বংশের সন্তান সে গল্প তারা বাপ-দাদাদের কাছে চিরকাল শুনে এসেছেন। আমরা শিয়াদের সঙ্গে শহরের শাহনাজাফ ইমামবড়ার মজলিসেও যেতাম, আবার বাড়িতে হিন্দুদের নবরাত্রি অনুষ্ঠানও পালন করতাম।
তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন, হুসাইনি ব্রাহ্মণদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে উভয় ধর্মের রীতিনীতি উদযাপনের এই প্রথা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
একই ধরনের আক্ষেপ শোনা গেল রাধিকা বুধওয়ারের কণ্ঠেও, যিনি এখন অস্ট্রেলিয়াতে কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত।
হুসাইনি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে রাধিকা বলছিলেন, আগে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজনকে দেখতাম যারা রমজান মাসে বেশ কয়েকটা রোজা রাখতেন, আবার মহররম মাসে আশুরাও পালন করতেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এমনও অনেকে ছিলেন যারা মাঝেসাঝে মসজিদেও যেতেন, জুম্মার নামাজে পর্যন্ত অংশ নিতেন।
তবে তাদের প্রজন্মে এসে এই রীতিগুলো ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সে কথা স্বীকার করতেও তার দ্বিধা নেই।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, যেহেতু অনেক হুসাইনি ব্রাহ্মণ পরিবারই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের ছেলেমেয়েরা ক্যান্টনমেন্টের মন্দির-মসজিদ-গির্জা সমন্বিত একটা উদার ও সহিষ্ণু পরিবেশে বেড়ে ওঠে – তাই তাদের মধ্যে 'ধর্মীয় ভেদাভেদও এমনিতেই খুব কম!
রাধিকা বুধওয়ারের কথায়, আমরা দাদি নানিদের কাছে খুব ছোট্টবেলা থেকে কারবালা যুদ্ধের গল্প শুনে আসছি। আমাদের পূর্বপুরুষ তার শ্রদ্ধার নায়কের জন্য একবারও না ভেবে নিজের সাত ছেলের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, এটা আসলে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের জন্য খুব গোপন গর্বের জায়গা।