Image description

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখন কার্যত নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে চাহিদা বেড়েছে নিত্যপণ্য কৃষি উপকরণ ও নির্মাণসামগ্রীর। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্তপথে গড়ে উঠেছে পাচারকারীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়মিত পাচার হচ্ছে ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, আলু, ইউরিয়া সার, কৃষি উপকরণ ও নির্মাণসামগ্রী।

বিশেষভাবে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির অন্তত ২৫টি সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করে আরাকান আর্মির কাছে পাঠানো হচ্ছে এসব সামগ্রী। সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীরা। চাঁদার বিনিময়ে সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার নাম ব্যবহার করে পাচার হচ্ছে মালামাল।

সম্প্রতি একটি বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েÑ যেখানে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) স্বাক্ষর জাল করে মিয়ানমারে পাচার করা হয়েছে ট্রলারভর্তি নির্মাণসামগ্রী। 

সেন্টমার্টিন দ্বীপে জেলা প্রশাসনের পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রটি দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতের জন্য টিআর প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দের আওতায় ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন ২৮ এপ্রিল একটি অনুমতিপত্র দেন। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সেই অনুমতিপত্রটি সংগ্রহ করেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদক। ইউএনও কর্তৃক ইস্যুকৃত, যার স্মারক নম্বর : ০৫.২০.২২৯০.০০০.০৯.১৪.২৫.৮১৭। ইউএনও গত ২৮ এপ্রিল ৯টি শর্তে কেন্দ্র সংস্কারের জন্য কিছু নির্মাণসামগ্রী বহনের অনুমতি দেন।

যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ সামগ্রী (৯ বাইন টিন, ৭০ ফুট কাঠ, ২০ ব্যাগ সিমেন্ট, ৩০ কার্টন টাইলস ও ৩০০ ফুট বালি) সেন্টমার্টিনে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতিপত্রটি গ্রহণকারী কর্মচারী আসেকুর রহমান ছাড়াও অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার, টেকনাফের ২ বিজিবির অধিনায়ক, কোস্ট গার্ডের টেকনাফ/সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার, বিজিবির টেকনাফ বিওপির কোম্পানি কমান্ডার, টেকনাফ থানার ওসি, সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে।

কিন্তু অনুমতিপত্রটি জালিয়াতি করে স্মারক নম্বরে অল্প পরিবর্তন এনে (৮১৭-এর স্থলে ৮১৬) এবং ২০ ব্যাগ সিমেন্টের স্থলে ৪০০ ব্যাগ সিমেন্ট উল্লেখ করে একটি সিন্ডিকেট। এরপর সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমের মালিকানাধীন একটি ট্রলারে এসব মালামাল বোঝাই করা হয়। যেখানে অনুমতিপত্রে উল্লেখ থাকা নির্মাণসামগ্রীর অতিরিক্ত বোঝাই করা হয়। কেরুণতলী ঘাটের সংশ্লিষ্টদের পাচারকারী সিন্ডিকেটের দেওয়া অনুমতিপত্রটি সংগ্রহ করেছেন প্রতিবেদক।

যদিও মোহাম্মদ আলম দাবি করেছেন, তিনি ট্রলারটি ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের এক নারী সেলিনা আক্তারের কাছে বিক্রি করে দেন, তবে ট্রলার বিক্রির স্ট্যাম্প থাকলেও তিনি ক্রেতার কোনো যোগাযোগ নম্বর দিতে পারেননি।

সেন্টমার্টিন ঘাটের সার্ভিস বোটের লাইনম্যান করিম উল্লাহ জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কিছু না জানলেও বিজিবির সদস্যরা তার কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে। যার প্রেক্ষিতে তিনি খোঁজখবর নিয়ে নির্মাণসামগ্রী পাচারের তথ্য পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ২৯ এপ্রিল ট্রলারটি টেকনাফ ঘাটে অবস্থান করছিল এবং ৩০ এপ্রিল দুপুর ১টার পর মাল বোঝাই করে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেয়। তবে ট্রলারটি দ্বীপে না পৌঁছে শাহ পরীরদ্বীপের বিপরীতে মিয়ানমারের ‘বাঘগুনা’ খালে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকেই সামগ্রী খালাস করে দেওয়া হয় রাখাইন রাজ্যে। 

নাফ নদ সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, ট্রলারটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকার জন্য পণ্য খালাস করেই ফিরে এসেছে।

অনুমতিপত্রের স্মারক নম্বরে অদলবদল এবং সামগ্রীর তালিকায় জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন।

এই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত সেন্টমার্টিন পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ আসেকুর রহমান সরাসরি জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে ইতোমধ্যে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন। 

এই জালিয়াতি ও পাচারের নেপথ্যে অনুসন্ধানে মিলেছে আট জনের সিন্ডিকেটের একটি চক্রের নাম। তারা হলেনÑ ট্রলার মালিক মোহাম্মদ আলম, সেন্টমার্টিন ঘাটের স্পিডবোটের লাইনম্যান জাহাঙ্গীর আলম, নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তার, জেলা প্রশাসনের কর্মচারী আসেকুর রহমান, সেন্টমার্টিন ইউপি সদস্য আকতার কামাল, ট্রলার মাঝি নুরুল ইসলাম, টেকনাফের কেফায়েত উল্লাহ ও আবদুল মোনাফের নাম। 

প্রসঙ্গত, এই সিন্ডিকেট গত বছর ১২ নভেম্বর একই কৌশলে দুটি ট্রলারে সিমেন্ট ও রড পাচার করেছিল।

নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আমি শুধু পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রটির সভাপতি। অনুমতি পেয়েছে কর্মচারী আসেকুর রহমান। জালিয়াতির বিষয়টি জানার পর আমি নিজেই খোঁজখবর নিই। তিনি আরও অভিযোগ করেন, সিন্ডিকেটটি অনুমতিপত্রের আড়ালে মাঝেমধ্যে মাদকের চালানও পাঠায় এবং দায় চাপায় আরাকান আর্মির ওপর।

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, জালিয়াতির বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। পাচারকারীরা অনুমতিপত্র বিকৃত করে অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ঘটনায় প্রশাসনের কর্মচারী জড়িত থাকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ইনচার্জ আসেকুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সাগরে আরেকটি ট্রলার থেকে ৬০০ বস্তা সার জব্দ

এদিকে ১ মে মধ্যরাতে সেন্টমার্টিন উপকূলে একটি মাছ ধরার ট্রলার আটক করে ৬০০ বস্তা ইউরিয়া সারসহ ১০ পাচারকারীকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড। তারা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে তারা সাগরে ছিল। জব্দকৃত সার কাস্টমসে জমা রাখা হয়েছে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। 

গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটায় এ তথ্য জানিয়েছেন কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এইচএমএম হারুন-অর-রশিদ।