Image description

রংপুরে বিচারক সংকটে বাড়ছে আদালতে মামলা জট। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে বিভিন্ন মামলার বিচারকাজ। বছরের পর বছর আদালতে ঘুরেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব মামলা। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি আর্থিক ও সময় দু’ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী-বিবাদীরা।

আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে মামলা দায়ের হচ্ছে সে হারে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর মামলার দায়েরের সংখ্যাও বাড়ছে। বিচারক সংকটের পাশাপাশি রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও চরম সংকট।

আদালত সূত্র জানায়, রংপুরে ছয়টি আদালতের মধ্যে গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। এরমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অধীনে সব ধরনের (অপরাধ) ক্রিমিনাল মামলা বিচারাধীন রয়েছে ১৩,০১৭টি এবং (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালসহ) সিভিলে (সাধারণ) মামলা রয়েছে ৩৩,৩২৩টি। এছাড়া স্পেশাল জজ আদালতে ৫৩০টি, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১০,০৪৭টি ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের আওতামুক্ত চারটি কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ১৯০০। বছরের পর বছর বিচার না হওয়ায় মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও। বর্তমানে তিনটি ট্রাইব্যুনালে ছয় হাজার ৪৩৮টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজার ৫৪২টি ধর্ষণের।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন ছয়টি আদালতে রাজস্ব খাতে পদের সংখ্যা ৩১টি থাকলেও খালি রয়েছে ১৮টি পদ। বিচারক পদ ৫টি থাকলেও রয়েছেন ৩ জন। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে কোর্ট ১০টি। বিচারকের পদ ৪টি। এতে বিচারক ৪ জন থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ২৩টি পদের মধ্যে সবগুলোই শূন্য। অন্য কোর্ট থেকে প্রেষণে এসে কাজ করছেন তারা। জেলা ও দায়রা জজ আদালতেও রয়েছে জনবল সংকট।

আদালতে হাজিরা দিয়েই জীবন পার বাদী-বিবাদীর

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের রেজাউল ইসলাম। জমিজমা সংক্রান্ত একটি মামলার আসামি তিনি। ১০ বছর ধরে চলছে মামলা। বাদীর টাইম পিটিশন, সাক্ষী না আসা, বিচারক না থাকাসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত তারিখ পরিবর্তন হয়। দশ বছর ধরে আদালতে হাজির হতে হতে আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি অপচয় হচ্ছে সময়।

 

রেজাউল ইসলাম বলেন, আমি কৃষক মানুষ। মামলায় হাজিরা দিতে এলে ওইদিন অন্য কোনো কাজ করা যায় না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। মামলার রায় যেটাই হোক, দ্রুত নিষ্পত্তি হলে বাঁচি।

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার খালাসপীর হাসারপাড়া গ্রামের বয়েত উল্লাহর ছেলে আব্দুল মান্নান। জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ২০১৬ সালে মামলা দায়ের করেন। প্রায় দশ বছর ধরে চলছে মামলা।

আব্দুল মান্নান বলেন, এই দশ বছরে ৪-৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে তার। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার কোনো ফলাফল পাচ্ছেন না।

২০১৬ সালে রংপুর নগরীতে ধর্ষণের শিকার হন দুই শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। কিন্তু ন্যায় বিচারের আশায় একে একে ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। আইনি জটিলতার কারণে ঝুলে থাকা মামলা নিয়ে লড়তে গিয়ে প্রতিবছর তাতে খরচ বাড়ছে, অপচয় হচ্ছে সময়।

বিচার শেষে মামলা নিষ্পত্তি হলেও লাগছে সময়। চাঞ্চল্যকর কিছু মামলার ক্ষেত্রে সময় কম লাগলেও অধিকাংশ মামলা চলছে বছরের পর বছর। পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের বাক প্রতিবন্ধী ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় প্রতিবন্ধী ওই নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। পরে ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এরপর ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত আবুল কালামকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন ওই নারীর বাবা।

আদালতের নির্দেশে ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করে পীরগাছা থানা পুলিশ। এরপর ধর্ষণে জন্ম নেওয়া শিশুর এবং অভিযুক্তের ডিএনএ পরীক্ষা ও ১১ বছরে ৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি আবুল কালামকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দেন বিচারক।

এটি শুধু ওই দুই শিক্ষার্থী ও বাক প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে নয়, এমন অসংখ্য মামলার জট আর জটিলতায় ঝুলছেন হাজারো ভুক্তভোগী। বছরের পর বছর ধরে তারা শুধু ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন।

আদালতে হাজিরা দিয়েই জীবন পার বাদী-বিবাদীর

ধর্ষণের শিকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সেবিকা আক্ষেপ করে বলেন, ২০১০ সালে মামলা করেছি। মামলা হওয়ার পর থেকে আজ ১৫ বছর ধরে আদালতে যাওয়া-আসা করছি। কিন্তু আমি সঠিক বিচার পাচ্ছি না। দিনের পর দিন আমার আইনজীবীকে শুধু টাকা দিচ্ছি আর নতুন নতুন তারিখ শুনে ফিরে যাচ্ছি। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো আভাস নেই। শুধু পদে পদে হয়রানি আর খরচ বাড়ছে।

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই আগের মামলার জট আছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে রাজনৈতিক এসব মামলার কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর জনবল সংকটতো রয়েছেই।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ড. রোকনুজ্জামান রোকন জাগো নিউজকে বলেন, আইনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, এটা বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত রায় প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করছেন, মামলা বিলম্বিত হলে সুযোগ পায় আসামিরা। এ কারণে মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত।

২০২৪ সালের ০৪ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে অ্যাডভোকেট রোকনুজ্জামান রোকন জাগো নিউজকে বলেন, দেশে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জন নাগরিকের বিপরীতে বিচারক মাত্র এক জন। অপরদিকে যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৮৬ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার জন, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪ হাজার ৩০০ জন, ভারতে ৪৭ হাজার ৬১৯ জন এবং পাকিস্তানে ৫০ হাজার জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা এক জন করে। এই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে, দেশে মামলাজটের অন্যতম প্রধান কারণ বিচারকের নগণ্য সংখ্যা। ফলে মামলা জট কমাতে হলে ১০ হাজার বিচারক নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামা নির্মাণসহ অন্যান্য ব্যবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া উচিত। সর্বোপরি এ বিষয় নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয়টার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আফতাব উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আদালতে বিচারক সংকট যেমন আছে তেমনি স্টাফদের সংকটও আছে। যেমন সদর কোর্টে চারজন বিচারক থাকার কথা কিন্তু সেখানে একজন বিচারকও নেই। এক কোর্টের বিচারক যখন অন্য কোর্টের বিচারকাজ পরিচালনা করেন তখন সময় তো লাগবেই।