Image description

প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পরও বেসরকারি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত পূরণ করতে পারেনি । আইনে ৫০ আসনের বিপরীতে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল এবং শয্যার বিপরীতে ৭০ শতাংশ রোগী ভর্তি থাকার শর্ত থাকলেও এই মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল ২০০ শয্যার এবং রোগী ভর্তির হার ১ শতাংশের কম । এই হাসপাতালও হয়েছে ২০২২ সালে । তবে নিবন্ধন পেয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে । চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে শয্যা ও শর্ত অনুযায়ী রোগী ভর্তি না থাকলে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন । এ কারণে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মানসম্মত চিকিৎসক তৈরিতে অবদান রাখতে পারছে না । অবশ্য ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি , গত ১৫ ডিসেম্বর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উদ্বোধন করা হয়েছে । শয্যা ৩০০ টি । কাজ শেষ না হওয়ায় পুরোদমে রোগী ভর্তি শুরু হয়নি । এর আগে শিক্ষার্থীদের গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি জানানো হয়েছে ।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর জানায় , ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজকে ২০১৯ সালের মে মাসে ৫০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেওয়া হয় । ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় । বর্তমানে রাজধানীর বাড্ডায় মাদানী অ্যাভিনিউর নিজস্ব ক্যাম্পাসে কলেজটির কার্যক্রম চলছে । সরকার প্রায় আড়াই বছর আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন , ২০২২ কার্যকর করে । আইনটি কার্যকরের আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো “ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা , ২০১১ ( সংশোধিত ) ' অনুযায়ী পরিচালনার বাধ্যবাধকতা ছিল । অভিযোগ রয়েছে , নীতিমালা মেনে চলায়ও ঘাটতি ছিল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের ।

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে কলেজটি পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাত সদস্যের পরিদর্শন কমিটি । কমিটির প্রতিবেদনে পরিদর্শনকালে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘাটতি শনাক্ত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিবেদনে বলা হয় , আইনে ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজের জন্য ২৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকার কথা থাকলেও পরিদর্শনে পাওয়া গেছে ২০০ শয্যা । রোগী ভর্তির হার ( বেড অকুপেন্সি রেট ) ১ শতাংশের কম । অর্থাৎ শয্যার ঘাটতি ৫০ টি ও রোগীর ঘাটতি ৬৯ শতাংশ । বহির্বিভাগে রোগী পাওয়া গেছে একজন । ক্লিনিক্যাল স্কিল ল্যাবের ঘাটতি রয়েছে । এতে কলেজের তৃতীয় থেকে পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে ।

আইন অনুযায়ী , বেসরকারি মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর ন্যূনতম দুই বছর আগে প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসে ভৌত অবকাঠামোসহ একটি হাসপাতাল চালু থাকতে হবে । ৫০ শিক্ষার্থীর আসনের মেডিকেল কলেজের জন্য হাসপাতাল হবে ২৫০ শয্যার । অর্থাৎ শিক্ষার্থীপ্রতি পাঁচটি শয্যা থাকতে হবে । শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য মোট শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার হবে ৭০ শতাংশ । পরবর্তীকালে যা কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ হাসপাতালে রূপান্তরিত হবে । আইনটি কার্যকরের আগে নীতিমালায়ও এমন ছিল । সূত্র জানায় , প্রতিষ্ঠার তিন বছর পরও ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল ছিল না । পরে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয় । গত বছরের শুরুতে সেখানে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ ওঠে । তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায় , ওই হাসপাতালের নিবন্ধন নেই । এতে তাৎক্ষণিক হাসপাতালের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় সরকার । গত বছরের শেষে নিবন্ধন পায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি । 

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পদস্থ দুই কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই কলেজের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ বিভিন্ন মহলের চাপ ' ছিল । হাসপাতালের নিবন্ধন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এখতিয়ার হওয়ায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বিষয়টির তদারক করেনি । একই ঠিকানায় দুই হাসপাতাল : মাদানী অ্যাভিনিউর ইউনাইটেড সিটিতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঠিকানায় ‘ ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস ' নামে আরও একটি হাসপাতাল পাওয়া গেছে । দুটি প্রতিষ্ঠান একই সেটআপে চলছে বলে জানা যায় । হাসপাতাল , ক্লিনিক , ব্লাড ব্যাংকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন - লাইসেন্স দানকারী ও নিয়ন্ত্রক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায় , ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের ( রেজিস্ট্রেশন কোড এইচএসএম ১৩৯৬৫ ) নিবন্ধন বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে । ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ( রেজিস্ট্রেশন কোড এইচএসএম ৮৯৯৩২ ) নিবন্ধনও হাসপাতাল হিসেবে । ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ বলছে , কলেজ , কলেজের হাসপাতাল ও হেলথকেয়ার সার্ভিসের ভবন আলাদা । দুটি হাসপাতালের সব চিকিৎসা কার্যক্রমের সেটআপ ( বিন্যাস ) আলাদা ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( হাসপাতাল ) ডা . আবু হোসেন মো . মঈনুল আহসান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ হেলথকেয়ার সার্ভিসেস ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে সব কাগজপত্র যাচাই - বাছাই করা হয় । ভিন্ন ভিন্ন জরুরি বিভাগ , বহির্বিভাগ , অপারেশন থিয়েটারসহ সবই সরেজমিনে পাওয়া গেছে । এখন হেলথকেয়ার সার্ভিস নামের হাসপাতালের সেটআপ না থাকলে তা কোথাও সরিয়ে নিয়েছে বা অন্য কিছু করেছে । কলেজ হাসপাতালের জনবল , যন্ত্রপাতি বা অন্য কিছু দেখিয়ে অন্য একটি হাসপাতালের নিবন্ধন নেওয়া বা নবায়নের সুযোগ নেই । বিষয়টি তদন্ত করব ।'

সরেজমিনে যা পাওয়া গেছে : ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে সরেজমিনে দেখা যায় , আড়াই একর জমিতে নয়তলা ভবনে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম চলছে । হাসপাতাল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত কলেজ ভবন । ভবনের নিচতলায় নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ । দ্বিতীয় তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত কলেজ । অষ্টম ও নবম তলা নির্মাণাধীন । হাসপাতাল ভবনেও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি । হাসপাতালের মূল ফটক থেকে প্রবেশ করলে বড় লবি । ডানে হাসপাতালের অভ্যর্থনা , অন্যদিকে ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসের অভ্যর্থনা । নিচতলায় জরুরি বিভাগ , বহির্বিভাগ ১ থেকে ৪ , ল্যাবরেটরি , স্যাম্পল কালেকশন , দ্বিতীয় তলায় বহির্বিভাগ , প্রশাসনিক ব্লক এবং কলেজের সঙ্গে সংযোগকারী পথ । তৃতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার , ক্রিটিক্যাল ইউনিট । সপ্তম তলায় নারী ও পুরুষ ওয়ার্ড , নাক , কান , গলা , চক্ষু , জেনারেল সার্জারি , অর্থোপেডিক ওয়ার্ড , আরেকদিকে কেবিন ব্লক । হাসপাতালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভর্তি রোগী দেখা যায়নি । কোনো কোনো ওয়ার্ডের কার্যক্রম শুরু হয়নি । চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ তলা এবং অষ্টম ও নবম তলা নির্মাণাধীন । হাসপাতালজুড়ে নির্মাণকাজের শব্দ । অবকাঠামো ছাড়া ইউনাইটেড হেলথকেয়ারে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চোখে পড়েনি ।

জানতে চাইলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা . আব্দুল ওয়াকিল আজকের পত্রিকাকে বলেন, “এখানে কলেজ, হাসপাতাল এবং হেলথকেয়ার তিনটি ভবনে । করিডর দিয়ে সব সংযুক্ত । ১৫ ডিসেম্বর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উদ্বোধন হয়েছে । এখানে ৩০০ শয্যা আছে । কাজ এখনো শেষ হয়নি । এর আগে শিক্ষার্থীদের গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রশিক্ষণ দিতাম । এটা মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে । এখন থেকে আমরা এখানেই হাসপাতালের কাজ চালাতে পারব । এখনো ৫ থেকে ১০ শতাংশ কাজ বাকি । রোগী বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি । রোগী ভর্তি করে যদি দেখা যায় , ওপরে শব্দ হচ্ছে , তাতে রোগী এবং আমরা অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়ব । এ জন্য আমরা বড় মার্কেটিং করিনি । এই হলো মূল বিষয় । আমরা আশাবাদী , এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি চালু করতে পারব । ' ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের সহযোগী পরিচালক ডা . আজমল কাদের চৌধুরী বলেন , “ এখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে । আমরা চিকিৎসা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কলেজ হাসপাতালকে এগিয়ে নিচ্ছি । রোগী বাড়ালেই হবে না , সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছি । আমাদের পুরো নজর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে । হেলথকেয়ার সার্ভিসেস নামের হাসপাতালের সব সেটআপ রয়েছে । সেখানে আপগ্রেডেশনের কাজ করছি ।

”চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন , স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর দায়িত্বশীল ভূমিকা না রাখায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার শর্তগুলো প্রতিপালন হচ্ছে না । চিকিৎসা শিক্ষার মানের উন্নতি না হওয়ার বড় কারণ অনুমোদনের শর্তে ছাড় এবং তদারকির অভাব । ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের ( ডব্লিউএফএমই ) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( ডব্লিউএইচও ) দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা . মোজাহেরুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ শর্ত না মানলে মেডিকেল কলেজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত । ভালো মানের চিকিৎসক তৈরি করতে না পারলে এগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি থাকার যৌক্তিকতা কী ? সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ে ঘাটতি পূরণ না করতে পারলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে । আর দুটি হাসপাতালের শর্তই হলো স্বতন্ত্র সেটআপ থাকা । ' তিনি বলেন , যাকে - তাকে কলেজের অনুমোদন দেওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া চিকিৎসকেরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিতে পিছিয়ে রয়েছেন ।

মেডিকেল কলেজের অনুমোদন ও নবায়নের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর , বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল ( বিএমডিসি ) নিয়মিত পরিদর্শন করে । তাদের প্রতিবেদনের আলোকে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত । ভালো চিকিৎসক তৈরির ক্ষেত্রে আপসের সুযোগ নেই । ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন কমিটির সভাপতি ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ( চিকিৎসা শিক্ষা ) অধ্যাপক ডা . রুবীনা ইয়াসমীন । কলেজ অনুমোদনে হাসপাতালের বিষয়ে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি — এমন প্রশ্নে তিনি বলেন , ' হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকায় একটি জটিলতা তৈরি হয়েছিল । স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল । আমরা ডিসেম্বরে গিয়ে জানতে পারি , তারা লাইসেন্স পেয়েছে । কলেজ কর্তৃপক্ষ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালকে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার করে বলে জানিয়েছে । ’