
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ ইউনিটেক্স । ১৯৮০ সালে ব্যবসা শুরু করেন গ্রুপটির কর্ণধার মো . হানিফ চৌধুরী । প্রথমে তৈরি পোশাক , পরে টেক্সটাইল , স্পিনিং , গ্যাস , সিনথেটিক খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ইউনিটেক্স গ্রুপ । ব্যবসা পরিচালনা করতে মো . হানিফ চৌধুরী প্রয়োজনীয় ঋণও নিয়েছিলেন কয়েকটি ব্যাংক থেকে ।
তবে ব্যাংকিং খাতে ইউনিটেক্সের আধিপত্য শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে ; হানিফ চৌধুরীর ছেলে বেলাল আহমেদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের বিয়ের পর । ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি শত শত কোটি টাকা ঋণ নিতে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে । বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা লোপাট করেছে গ্রুপটি । এ ছাড়া রূপালী ব্যাংক থেকে ৩২৬ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ৪৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪০ কোটি মিলিয়ে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা ।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম পরিবারের মতো গা ঢাকা দিয়েছেন ইউনিটেক্সের কর্ণধারেরাও । এরপর খারাপ হতে শুরু করে গ্রুপটির ঋণমান । ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা । এমনকি ঋণের টাকা উদ্ধারে গ্রুপটির বন্ধক রাখা স্থাপনাসহ সম্পত্তি নিলামে তুলেছে ব্যাংকটি । যদিও এই সম্পত্তি ( ৬২ দশমিক ৭৫ একর ) বিক্রি করে ঋণের ২ শতাংশ ( ৮৩ কোটি ) টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা ।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান , শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে বেলাল আহমেদ ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ হাতিয়ে নেন । ঋণ বিতরণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি । ঋণের তুলনায় বন্ধকি সম্পত্তি খুবই অপ্রতুল । তাই ঋণের টাকা আদায়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক । ইসলামী ব্যাংকের ঋণের মধ্যে ইউনিটেক্স স্টিলের নামে ৮১৪ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির পাহাড়তলী শাখা থেকে ।
শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন , ইউনিটেক্স স্টিলের ঋণ অনুমোদন হয় ২০২২ সালে । ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী , প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৩৮৮ কোটি ৫০ লাখ ফান্ডেড এবং ৩০০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ( যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র ) অর্থাৎ ৪২৬ কোটি টাকার দায় তৈরি হয়েছে । তবে আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে , ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ নিলেও ইউনিটেক্স স্টিল এখনো একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান । প্রতিষ্ঠানটির নামে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ১৮৮০ শতক জমি কেনা হলেও সেখানে কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি । ঋণের বিপরীতে ওই জমিগুলোই কোলাটারেল ( বন্ধক ) দেওয়া হয়েছে ব্যাংকে, যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ২৮ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা । এ ছাড়া বন্ধক রাখা জমিগুলো কেনা হয়েছে ২০২২ সালে । অর্থাৎ কারখানা তৈরি ও জমি কেনার আগেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক ।
ইসলামী ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান সরকার বলেন , ‘ কারখানা স্থাপনের আগেই প্রতিষ্ঠানটিতে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে । ঋণের টাকা উদ্ধারে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তুলেছি । একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে । ” ইউনিটেক্স গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন , “ আমরা ঋণ নিয়ে জমি কিনেছি । আমাদের এই প্রকল্প চলমান । এখনো শেষ হয়নি । তার মধ্যে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক । অর্থায়নের অভাবে চলমান প্রকল্প বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান খেলাপি হওয়ায় আমাদের পুরো গ্রুপের ওপর প্রভাব পড়বে ।' গ্রুপটির বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে ।
এর মধ্যে রয়েছে ইউনিটেক্সে এলপি গ্যাসে ২ হাজার ২৩ কোটি , ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিংয়ে ৬০৭ কোটি এবং এবং ইউনিটেক্স গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ২৯৩ কোটি টাকা । প্রতিষ্ঠান তিনটির কোলাটারেল ( স্থাপনাসহ জমি ) খুবই নগণ্য , যা বিক্রি করে সর্বোচ্চ ৫৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা । ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান , এস আলমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে প্রথম ঋণ নেয় ইউনিটেক্স ।
প্রথম দিকে নেওয়া কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসের ঋণটিতে কিছুটা হলেও নিয়মনীতি মানা হয়েছে । কিন্তু ২০২২ সালে গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের নামে নেওয়া ঋণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি । গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ইতিমধ্যে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণ ছাড় হয়েছে । যদিও প্রতিষ্ঠানটির কারখানার এখনো একতলা নির্মাণ শেষ হয়নি । অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করলেও কারখানা নির্মাণের আগে ফান্ডেড ঋণ ছাড়ের কোনো সুযোগ নেই । এমনকি গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে , যার বিপরীতে কোলাটারেল মাত্র ৪ কোটি টাকা ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে , প্রথম দিকে নেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং ও এলপি গ্যাসে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মো . হানিফ চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো . বেলাল আহমেদের নাম রয়েছে । কিন্তু সম্প্রতি নেওয়া দুই প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স স্টিল ও গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ে মালিকানা দেখানো হয়েছে তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে । যদিও এসব ঋণের সরাসরি বেনিফিশিয়ারি হানিফ ও বেলাল । মূলত ঋণের দায় এড়াতে তাঁরা এ কৌশল অবলম্বন করেছেন বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ।
আত্মীয়স্বজনের কোম্পানিগুলোতে নাম রয়েছে বেলালের স্ত্রী মাইমুনা খানম ( এস আলমের মেয়ে ) , চাচা আব্দুল আজিজ , ফুফা শহীদুল্লাহ কাইছার , কাজিন সৈয়দ মশিউদ্দিন আহমেদ , সৈয়দ মহিউদ্দিন আহমেদ ও মো . মোহাইমেনুল ইসলাম চৌধুরী । ইউনিটেক্স গ্রুপের কর্ণধারদের মধ্যে বেলাল আহমেদ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রী মাইমুনা খানম ( এস আলমের মেয়ে ) গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন । ইউনিটেক্স গ্রুপের ঋণ প্রদানে যে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি তার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও ।
ওআর নিজাম রোড শাখা থেকে দেওয়া ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং, এলপি গ্যাস এবং গ্র্যান্ড স্পিনিংয়ের ঋণ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে , প্রতিষ্ঠানের ঋণ আবেদন , মঞ্জুরি , বিতরণ , লেনদেন , বার্ষিক টার্নওভার , আর্থিক প্রতিবেদন , আয়কর বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে , প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে । যে বিনিয়োগ ফান্ড ডাইভার্ট করার আশঙ্কা রয়েছে । ২০১৭ সাল থেকে ঋণ দেওয়া হলেও ইউনিটেক্সের চেয়ারম্যান মো . হানিফ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ ও পরিচালক মাইমুনা খানমের অনুকূলে দেওয়া ঋণের তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করা হয়নি । ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান তিনটির মর্টগেজ করা সহায়ক জামানতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে । কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ১১৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গ্র্যান্ড স্পিনিংকে । এমনকি কারখানা প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে ২৯৩ কোটি টাকা ঋণছাড় করেছে ব্যাংক ।
ইউনিটেক্স গ্রুপের জিএম ( ফাইন্যান্স ) মোহাম্মদ মোস্তাক বলেন , ‘৪৫ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে ইউনিটেক্স গ্রুপ । ৫ আগস্টের আগে আমাদের ঋণখেলাপি হওয়ার রেকর্ড নেই । এস আলম পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হলে পুরো ইউনিটেক্স গ্রুপই বিপাকে পড়বে । ঝুঁকিতে পড়বে ব্যাংক ও গ্রুপের বিনিয়োগ । কর্মসংস্থান হারাবে কয়েক হাজার লোক , যা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয় । বিনিয়োগ সুবিধা অব্যাহত রেখে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি ।'
ইউনিটেক্স গ্রুপের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন , ‘ইউনিগ্যাস ' নামে বাজারজাত হওয়া ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে । প্ল্যান্ট দুটির সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৫ হাজার ১৫০ টন । প্ল্যান্ট দুটি নির্মাণসহ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রয়োজন । কিন্তু কোম্পানিটির নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি । উল্লেখ্য , ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ । ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম । ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী , ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে- বেনামে ও তাঁদের স্বজনেরা মিলে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছেন । ৫ আগস্টের পর থেকে এস আলম পরিবার ও তাঁর স্বজনেরা গা ঢাকা দিয়েছেন ।