Image description
পুরোনো বেতার ভবন পরিত্যক্ত » বেতারের শাহবাগের এই ভবন ২০১৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন বিএসএমএমইউকে হস্তান্তর করা হয় । এটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত ভবন । বেতারের স্মৃতি- ঐতিহ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই । নিচতলায় জরাজীর্ণ কক্ষগুলোতে থাকছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আনসার সদস্যরা ।

ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশ বেতারের পুরোনো সদর দপ্তর ভবন। রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত এই ভবনের অবস্থা এখন করুণ। বেতারের স্মৃতি-ঐতিহ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রায় পরিত্যক্ত এই ভবন এখন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ/পিজি) জন্য কাজ করা আনসার সদস্যদের বাসস্থান।

৭ বছর আগে খাসজমিসহ এই ভবন বিএসএমএমইউকে হস্তান্তরের সময় শর্ত ছিল, বেতারের জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে এই স্থাপনা কাজে লাগাবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তা করা হয়নি।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নোমান মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের যে ভবনটি দেওয়া হয়, যদিও কাগজে-কলমে লেখা আছে, এটি সংরক্ষণ করতে হবে, কিন্তু দেওয়ার সময় এবং গ্রহণ করার সময় কোনো এক অদৃশ্য কারণে সম্ভবত ভবন ও যন্ত্রপাতি আর রক্ষা করা হয়নি। যে জিনিসগুলো বেতারের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো নিয়ে গেছে। বাকিগুলো অকার্যকর, সংরক্ষণ করার মতো ছিল না। এটা এখন পরিত্যক্ত জায়গা।’

ইতিহাস বলছে, ষাটের দশক থেকে প্রায় পাঁচ দশক শাহবাগের এই ভবনে ছিল বাংলাদেশ বেতারের সদর দপ্তর। পরে তা আগারগাঁওয়ে স্থানান্তর করা হলে বেতারের এই জমি ও ভবন হস্তান্তর করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (সাবেক বিএসএমএমইউ)। তখন সংস্কৃতিকর্মীদের আশঙ্কা ছিল, অনেক ঘটনার সাক্ষী এই ভবন অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ায় ইতিহাস-ঐতিহ্য নষ্ট হবে।

১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাজিমউদ্দিন রোডে ভাড়া করা একটি বাড়িতে যাত্রা শুরু করা বেতারের নাম ছিল ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’। পরে নামকরণ করা হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরে প্রথমে নাম হয় ‘পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ঢাকা’; পরে হয়েছিল ‘রেডিও পাকিস্তান’। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগে তিন একর জমির ওপর ভবন নির্মাণ করে সেখানে নেওয়া হয়েছিল বেতারের পুরো কার্যক্রম।

বেতারের শাহবাগের এই ভবন ২০১৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন বিএসএমএমইউকে হস্তান্তর করা হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ একটি ভবন বা জায়গা বিএসএমএমইউ নিয়ে কী করবে? এমন প্রশ্ন তখন উঠেছিল। তখন জানানো হয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিহাস রক্ষা করেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। যদিও এই ভবনে এখন আর বেতারের কিছুই নেই। অনেকটা পরিত্যক্ত হলেও এখানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা থাকছেন।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদক শাহবাগে গিয়ে প্রধান ফটক পেরিয়ে বেতার ভবন ঢুকতেই আনসারদের একটি নিরাপত্তাচৌকি চোখে পড়ে। আনসার সদস্যরা ভেতরে যেতে অনুমতি দেন। ভবনের সামনে এবড়োখেবড়ো আঙিনা, বড় একটি ক্রেন। আঙিনাজুড়ে ময়লা ও ইট-সুরকির ছোট ছোট স্তূপ। ভবনটির দেয়ালে সাঁটানো সবুজ রঙের সাইনবোর্ড, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আনসার ক্যাম্প’। দেয়ালে শেওলা ধরেছে, পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভেতরে আবছা অন্ধকার। নিচতলায় রয়েছে বেশ কিছু কক্ষ। তাতে থাকছেন আনসার সদস্যরা। কক্ষগুলোর মধ্যে জামাকাপড় ঝোলানো। ব্যবহৃত আসবাব রাখা। কোনো কক্ষে বেতারের কোনো সরঞ্জাম বা স্মৃতি খুঁজে পাওয়া গেল না।

‘বাংলাদেশের বেতার মানেই গণমাধ্যম সংস্কৃতির একটি ইতিহাস। বেতার মানেই সবার একটা নস্টালজিয়া কাজ করে।’ বলেন বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অনুষ্ঠান, চলতি দায়িত্ব) মু. আনোয়ার হোসেন মৃধা। তিনি বলেন, ‘আমরা মৌখিকভাবে (তৎকালীন) বিএসএমএমইউকে বলেছি, এটা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ বেতারের অংশ হিসেবেই যেন ভবনটি থাকে। তাদের যে কারণে দেওয়া হয়েছিল, সেটা তারা ব্যবহার করতে পারেনি। এখন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায়।’

সংস্কৃতিকর্মীরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো একটা জাতির পরিচয়বাহক। এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। পৃথিবীর নানা দেশে পুরোনো ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করার নজির আছে।

প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের দেশে কোনো আগ্রহ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ বেতার ভবন শুধু গণমাধ্যম সংস্কৃতির সঙ্গেই নয়; মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সংগীতের বিশাল প্রসারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে বেতার। সুতরাং এটা সংরক্ষণ করা দরকার। শুধু একটি ভবন টিকিয়ে রাখা নয়, এখানে জাদুঘর করার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটা সেতুবন্ধ তৈরি করা যায়।’

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক বলেন, এটা (বেতার ভবনের পরিত্যক্ত অবস্থা) কীভাবে হলো, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনও অবাক! সে সময় পরিস্থিতি এমন ছিল যে হস্তান্তরের সময় এ বিষয়ে প্রশ্ন করারও সুযোগ ছিল না। যাঁরা হস্তান্তর এবং গ্রহণপ্রক্রিয়ায় ছিলেন, এই দায় কি তাঁরা নেবেন? তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্ল্যান দিতে বলা হয়েছে। আমরা এখন ভবন নিয়ে কী করব, সেই পরিকল্পনা করছি।’