
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। প্রশাসনের একাধিক আশ্বাস ও তদন্ত প্রতিবেদন সত্ত্বেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ছাড়াও অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা হয়, যার ফলে আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থাকলেও হামলাকারীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অফিস করতেছেন বলে অভিযোগ করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
হামলার পর শিক্ষার্থীরা কয়েক দফা আন্দোলন করেন এবং বিচার দাবিতে স্মারকলিপি দেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো মামলা হয়নি, বরং প্রশাসন শুধু বহিষ্কার আর ফলাফল বাতিলের ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, বারবার আশ্বাসের ফাঁদে পড়ে বিচার পেতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরও মামলার কথা জানালেও, তার ভিত্তিতে কোনো মামলার উদ্যোগ নেয়নি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা, ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছে, তদন্ত ও ন্যায়ের নামে দীর্ঘসূত্রতা কার স্বার্থে?
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ছিল যারা জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সরাসরি হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পযন্ত কোনো মামলা করতে পারেনি। এমন দাগী কিছু অভিযুক্ত ১৫ জনের তালিকায় রয়েছেন,এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগের শাখা সভাপতি পমেল বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহাফুজ, সংগঠনের কর্মী ধনঞ্জয় কুমার টগর, গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), বাবুল, বিধান, তানভীর, আদুল্লাহ আল নোমান খান, রিফাত, ফারহাদ হোসেন এলিট, মোমিনুল, আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান, আরিফ ও মামুন।
আবার কিছু কর্মকর্তা -কর্মচারী শিক্ষক রয়েছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আবু সাঈদ হত্যার দিনে শিক্ষক আসাদ মন্ডল এবং মশিউর রহমানসহ বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঘটনাস্থলে দেখতে পাওয়া যায়। এই সকল কর্মকর্তারা জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থীদের হামলার সাথে জড়িত হওয়ার পর এখনো তারা স্ব পদে বহাল আছে। নেই কোনো আইনি পদক্ষেপ। কিন্তু কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই এখনো প্রকাশ্যে অফিস করেন । সাবেক উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, পেনশন শাখার উপপরিচালক রিয়াজুল ইসলাম, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন সর্দার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর নুরুজ্জামান, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কর্মচারী বিপ্লব, বহিষ্কৃত সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ, ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুল ইসলাম, পরিবহন পুলের উপপরিচালক তাপস কুমার গোস্বামী,তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মচারী ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মাহবুবার রহমান, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়া, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার উপরেজিস্ট্রার হাফিজ আল আসাদ রুবেল, মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আহসান হাবীব তুষার, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সেশন অফিসার এ কে এম রাহিমুল ইসলাম দিপু, প্রক্টর অফিসের কর্মচারী মো. আপেল ও সংস্থাপন শাখা-১ এর কর্মচারী সবুজ, ট্রেজারার অফিসের কর্মকর্তা মাজাহারুল আনোয়ার। রেজাউল ইসলাম লাবু- ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বরত কর্মকর্তা।
রেজাউল ইসলাম লাবুকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে এসব কর্মকর্তা কর্মচারী শিক্ষক ১৬ জুলাইয়ের দিনে শিক্ষার্থীদের হামলার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা বা মামলা দিতে পারেনি। যদিও প্রশাসন শুরুর দিকে মামলার কথা বললেও বিভিন্ন টালবাহানায় সময়ক্ষেপণ করতেছে। আদৌও কি মামলা হবে নাকি হবে না এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
এ বিষয়ে হামলার শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, তারা এখনও মানসিকভাবে আতঙ্কে আছেন এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলার শিকার হয়েছি, ৮ মাসেও কোনো বিচার পাইনি। এটা শুধু অবিচার নয়, লজ্জাজনকও। আশ্বাসে আশ্বাসেই দিন কাটছে। হামলাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমরা আতঙ্কে পড়াশোনা করছি। প্রশাসনের নীরবতা অনেক কিছু বলছে। হামলার দিন শুধু শরীর নয়, মনও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। মেয়েদের ওপর যেভাবে চড়াও হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে শহীদ আবু সাইদের সহযোদ্ধা রুবায়েদ জাহিন বলেন আমি মামলা না হওয়ায় হতাশ, প্রথম থেকে প্রশাসন স্লো কাজ করতেছে,তদন্ত কমিটি গঠন করেও এখনও মামলা করতে পারেনি, ছোট খাটো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তবে হ্যাঁ মামলা করবে, এই জন্য যে আইনি প্রক্রিয়া আছে সেগুলো শেষ করবে, ইতিমধ্যে সিন্ডিকেটে পাস হয়েছে, এখন দেখা যাক কি করে প্রশাসন।
শহীদ আবু সাইদের আরেক সহযোদ্ধা আহমাদুল হক আলবির বলেন,জুলাই বিপ্লবের উপর দাঁড়িয়েও ভার্সিটির প্রশাসনকে দেখছি জুলাই বিপ্লবকে ধারন না করতে। আমরা দেখেছি জুলাই আন্দোলনে ভার্সিটির প্রশাসন ছাত্রদের সহযোগিতা করে নাই বরং কিছু শিক্ষক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছিলো। আশা করছিলাম বিজয় পরবর্তী প্রশাসন তৎকালীন ভার্সিটির নির্লজ্জ প্রশাসন থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীবান্দব হবে।কিন্তু বর্তমান ভার্সিটির প্রশাসন মুখে বিপ্লবের কথা বললেও তাদের কার্যক্রমে আমরা বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই না। ভার্সিটির প্রশাসন এতো সময় অতিক্রম করার পরেও জুলাই আন্দোলন হামলাকারীদের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেই নি,কোন আইনি আপনি পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখি না। তাদের এই কার্যক্রম মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দেয়। প্রশাসনের এই নির্লিপ্ত আচরণে শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক শওকাত আলী বলেন, আমরা হামলাকারীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এ বিষয়ে জুলাই আগস্টে আহতদের সাক্ষীও আমরা নিয়েছি। মামলার প্রসেসিং চলমান রয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যে এর আউটপুট পাওয়া যাবে।