
অনিয়ম শনাক্ত হওয়ায় আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি’ সুবিধাভোগীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার নাম। ফলে উল্লিখিত কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক লাখ থেকে কমিয়ে ৮০ লাখ ৫০০ জনে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি এ কর্মসূচির ভাতার পরিমাণ কোনো স্তরেই বাড়ানো হচ্ছে না। তবে উচ্চতর স্তরে ৫০০ সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্রমতে, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি ভাতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে প্রাথমিক স্তরে। শিক্ষাজীবনে চারটি স্তরে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে প্রতিবন্ধীদের। এগুলো হচ্ছে-প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তর। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৬২ হাজারের মধ্যে ১৫ হাজার হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থী। যারা প্রতিবন্ধী সেজে ভাতা নিচ্ছে। একইভাবে মাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ২৬ হাজার, যার মধ্যে চার হাজারই অনিয়মের মাধ্যমে ভাতা তুলে নিচ্ছে। অর্থাৎ এ স্তরে প্রকৃত ভাতাভোগী হচ্ছে ২২ হাজার। একইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আট হাজার উপবৃত্তি পেলেও এর মধ্যে ৫শ অনিয়মের মাধ্যমে ভাতা নিচ্ছে। এ স্তরে প্রকৃত ভাতা পাওয়ার উপযোগী হলেন সাত হাজার পাঁচশ। তবে এ তিনটি ছাড়াও উচ্চতর স্তরে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন চার হাজার। এক্ষেত্রে তেমন কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি।
সূত্রমতে, চলতি (২০২৪-২৫) বাজেটে এ কর্মসূচিতে ১১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। যার মধ্যে ২১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে বের হয়ে গেছে। অর্থাৎ এ কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের প্রায় ১৯ শতাংশ টাকা অপচয় হয়েছে। এছাড়া গত চার অর্থবছরে (২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪) প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয় এই কর্মসূচিতে। ওই হিসাবে প্রায় একশ কোটি টাকাই অনিয়মের মাধ্যমে বেরিয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ যুগান্তরকে জানান, চলতি অর্থবছরে এক লাখ প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১৯ হাজার ৫০০ সাধারণ শিক্ষার্থী ঢুকে আছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর ভাতাও নিচ্ছে, আবার প্রতিবন্ধী উপবৃত্তির টাকাও নিচ্ছে। এবার তাদের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবন্ধী উপবৃত্তির টাকা বন্ধ করব। ওরা শুধু সাধারণ শিক্ষা ভাতা পাবে। যে কারণে আসন্ন বাজেটে এ কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমলেও কিন্তু প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা কমছে না।
এদিকে আগামী বাজেট কেন্দ্র করে সম্প্রতি ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক হয়েছে। সেখানে উপবৃত্তির ভাতা ঘিরে এ নিয়মের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয় বিগত সময়ে কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা। এসব দিক পর্যালোচনা করে ওই বৈঠকে বিদ্যমান এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী উপবৃত্তির সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে ৮০ হাজার ৫শ জন নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া যে চারটি স্তরে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে এর মধ্যে উচ্চতর স্তরে ৫শ নতুনভাবে সুবিধাভোগী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে উপবৃত্তির সব স্তরে ভাতার অঙ্ক অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। নতুন করে ভাতার পরিমাণ বাড়ছে না। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ। বৈঠকের সিদ্ধান্তে তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী উপবৃত্তি ঘিরে বিগত সময়ে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু সে সময়ে এর প্রতিরোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মতো সব সেবা নিতে অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ সব ক্ষেত্রেই তারা কমবেশি দুর্নীতির শিকার হন। উপবৃত্তির তালিকাভুক্তি, বইপ্রাপ্তি, ভর্তি-পুনঃভর্তিতে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন ১১ দশমিক ৩ শতাংশ, ঘুস দিতে হচ্ছে ৮ শতাংশকে।
সূত্রমতে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আগামী অর্থবছরে বাজেটে ৮১ হাজার ৫০০ প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়ার প্রাথমিক তালিকা প্রণয়ন করেছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে দেওয়া হবে ৪৭ হাজার, মাধ্যমিক স্তরে ২২ হাজার, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সাত হাজার ৫০০ জন এবং উচ্চস্তরে দেওয়া হবে উপবৃত্তি চার হাজার ৫০০ জনকে। এজন্য ৯২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষালাভের সহায়তা হিসাবে ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি’ প্রবর্তন হয়। শুরুতে এ কর্মসূচিতে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২০৯ জন। মাসিক উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৩০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ টাকা ছিল। পর্যায়ক্রমে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও উপবৃত্তির হারও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ৯০০, মাধ্যমিক স্তরে ৯৫০, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১০৫০, উচ্চতর স্তরে ১৩০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। যা আগামী অর্থবছরের বাজেটেও একই অঙ্কের ভাতা দেওয়া হবে।