মইনুল ইসলাম চৌধুরী: আমাদের এই কমিশন একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন। এই কমিশনের প্রতিবেদনের ফলে কোনো আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ট্রাইব্যুনালে যে প্রতিবেদন দেবে, সেটা হলো পুলিশ প্রতিবেদন। এই কমিশন কোনো তদন্তকারী সংস্থাও নয়, প্রসিকিউটিং এজেন্সিও নয়। কমিশনের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক রসদও এখানে রয়েছে।
মামলার অনেক আলামত কমিশনের প্রতিবেদনে থাকবে। গুম হওয়া যেসব ব৵ক্তি ফেরত এসেছেন অথবা যাঁরা ফেরত আসেননি, তাঁদের স্বজনেরা আমাদের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা যেসব এলাকার বা গোপন বন্দিশালার যে বর্ণনা দিচ্ছেন, আমরা সশরীর সেসব জায়গায় গিয়ে দেখছি। ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের বর্ণনার সঙ্গে সেগুলোর মিল রয়েছে। এটি অবস্থাগত সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
এর সঙ্গে ভুক্তভোগীদের চাক্ষুষ প্রমাণও আমরা পাচ্ছি। নিরপেক্ষ সাক্ষী পাওয়ার সুযোগ নেই। যারা ধরে নিয়ে গেছে, নির্যাতন করেছে, বছরের পর বছর বেআইনিভাবে বন্দী করে রেখেছে, তারা তো নিজেদের বিপক্ষে কথা বলবে না। যেমন ব্যারিস্টার আরমান ও জেনারেল আযমীকে যারা আট বছর অবৈধভাবে আটকে রেখেছে, তারা তো অপরাধের কথা বলবে না। হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে রেখেছে সাত মাস। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে রেখেছে আড়াই থেকে তিন বছর। কোনো মামলা ছাড়াই বছরের পর বছর বন্দী রেখে তাঁদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে।
হুম্মাম কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে বন্দিদশা থেকে ছাড়ার সময় তাঁকে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী তোমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। রাজনীতি ছাড়ো, বিদেশে চলে যাও। অবস্থার উন্নতি হওয়ার আগে দেশে এসো না।’
গোপন বন্দিশালাগুলোতে কী ধরনের আলামত পেয়েছেন? এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ কিংবা আলামত নষ্ট করে ফেলার আশঙ্কা আছে কি না। যেমন গুমের ঘটনায় আর্জেন্টিনায় নুনকামাস কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেক প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: দু–চারটা গোপন বন্দিশালায় কিছু আংশিক পরিবর্তন করা হয়েছে, দেয়ালে বন্দীদের লেখা নাম, মুঠোফোন নম্বর, মনের অনুভূতিসহ বিভিন্ন তথ্য দেয়ালে রং করে মুছে ফেলা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার এ–সংক্রান্ত প্রমাণাদি আংশিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। যেমন কোথাও একাধিক সেল ছিল, সেটা ভেঙে একটা করা হয়েছে বা একটা ছিল, সেটা ভেঙে তিনটা করা হয়েছে।
এগুলো বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো পরিবর্তন করা হয়েছে বলে আমরা দেখেছি। আমরা সেখানে গিয়েছি, তাদের বলে এসেছি সেগুলো যে অবস্থায় ছিল, সেভাবে রাখতে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার বা মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এগুলো অক্ষত অবস্থায় রাখতে হবে। কারণ, এগুলো অবস্থাগত প্রমাণ। আমরা চিঠি দিয়েও তাদের এ বিষয়ে বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়েছেন। তা ছাড়া গোপন বন্দিশালাগুলোকে জাদুঘর করা হবে কি না—সে বিষয়ে আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলব।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য। একক ব্যক্তির হাতে যেন সব ক্ষমতা না থাকে, সে জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। এ জন্য সংবিধানের পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন। পাশাপাশি সুশাসন লাগবে। আর রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে এ দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না; গুম থামবে না।
বন্দিশালায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের আটক রাখাসংক্রান্ত কোনো নথিপত্র পেয়েছেন কি?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বন্দিশালায় আটকে রাখার গোপন নথি পাইনি। যেমন র্যাবে পাওয়া গেছে, ডিজিএফআইতে পাওয়া যায়নি। এর মূল কারণ হলো যেহেতু এটি বেআইনি কাজ, এ জন্য তারা এ–সংক্রান্ত নথিগুলো সংরক্ষণ করত না। বন্দীকে ছেড়ে দেওয়ার পর নথিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হতো। বিশেষ করে ডিজিএফআইয়ে এটা বেশি দেখা গেছে।
কাউকে গুম করার সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন কীভাবে হতো? যারা এই কাজে জড়িত ছিল, তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা বা পুরস্কার থাকত?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: আগে ঠিক করা হতো কাকে গুম করা হবে। তাঁকে নজরদারিতে রেখে সুবিধামতো জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হতো। বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটত সন্ধ্যার পরে। কখনো একটি বাহিনী, কখনো একাধিক বাহিনী একটি ঘটনায় যুক্ত হয়ে গুম করত। যেমন অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা ডিজিএফআইয়ের নেই। এ জন্য কখনো তারা র্যাবকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো র্যাব বা ডিবির জ্যাকেট পরে গুম করত। গুম বাস্তবায়নকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অত্যন্ত সমন্বিতভাবে এই কাজ করত। ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশ–কাঠামোর’ মাধ্যমে কাজটি করা হতো। যারা গুমের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল, তাদেরকে পদোন্নতি, বিভিন্ন মিশনে বিদেশে পাঠানো ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হতো।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনাতেই গুমের ঘটনাগুলো ঘটত। তারেক সিদ্দিকসহ (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা) কয়েকজনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনাগুলো আসত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্দেশনা দেওয়া হতো মুঠোফোনে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত অথবা পরিচিতি রয়েছে, এমন ভুক্তভোগী বা সাক্ষীদের বক্তব্যে বিষয়টি এসেছে। আবার গুমের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাদের আমরা সমন দিয়েছি, তাদের বক্তব্যেও শেখ হাসিনার নির্দেশনার বিষয়টি এসেছে। যেমন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এটা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন।
গুম হওয়া ভুক্তভোগীকে তুলে নেওয়া ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাস্ক, টুপি ও সানগ্লাস পরে রাতের আঁধারে এমনভাবে আসত, যাতে চেহারা চেনা না যায়। তারা ভুক্তভোগীকে ধরেই মাথা থেকে গলা পর্যন্ত লম্বা টুপি পরিয়ে দিত। অনেক ক্ষেত্রে এক বাহিনীর সদস্যরা আরেক বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মানুষকে তুলে এনে ধূম্রজাল তৈরি করত।
গুম করে কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কাউকে কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, অনেককে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, আবার কাউকে কাউকে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়েছে। এগুলো নির্ধারিত হতো কীভাবে?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, এই বিষয়গুলো ঠিক করা হতো কাউকে তুলে নেওয়ার পরে। কাউকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তারা যাচাই করত। কখনো কখনো কাউকে তুলে নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করত। পরে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হতো ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশ–কাঠামোর’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। রাজনৈতিক ব্যক্তি বা নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে বিগত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। যেমন হুম্মাম কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে বন্দিদশা থেকে ছাড়ার সময় তাঁকে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী তোমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। রাজনীতি ছাড়ো, বিদেশে চলে যাও। অবস্থার উন্নতি হওয়ার আগে দেশে এসো না।’
এসবের বাইরে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের দ্বারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের ভারতের সঙ্গে বিনিময়ের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ বিনিময়গুলো ‘বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি’র আওতায় হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে সেটি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের সংস্থাগুলোর একধরনের গোপন বোঝাপড়া ছিল। ভারতে যাওয়ার পরে ওই ব্যক্তিদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
গুমের ঘটনায় জড়িত কনিষ্ঠ কর্মকর্তা এবং সৈনিক, কনস্টেবল বা মাঠপর্যায়ের সদস্যদের পক্ষ থেকে যুক্তি আসতে পারে তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে কাজ করেছেন। তাঁদের বিষয়টা কীভাবে দেখবেন?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: যাঁরা গুমের হুকুম দিয়েছেন, গুমের কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ঊর্ধ্বতন পদে ছিলেন; কিন্তু এগুলো দেখেও ব্যবস্থা নেননি অথবা যাঁরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ মেনে গুম করেছেন—এঁদের সবাই অপরাধী। বেআইনি আদেশ পালনও অপরাধ।
একেবারে মাঠপর্যায়ে জড়িত, এমন ব্যক্তিদের কতটা শনাক্ত করা যাচ্ছে?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: গুম হওয়া ভুক্তভোগীকে তুলে নেওয়া ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাস্ক, টুপি ও সানগ্লাস পরে রাতের আঁধারে এমনভাবে আসত, যাতে চেহারা চেনা না যায়। তারা ভুক্তভোগীকে ধরেই মাথা থেকে গলা পর্যন্ত লম্বা টুপি পরিয়ে দিত। অনেক ক্ষেত্রে এক বাহিনীর সদস্যরা আরেক বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মানুষকে তুলে এনে ধূম্রজাল তৈরি করত। ফলে মাঠপর্যায়ের অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেটি করব, নির্দেশদাতা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা, বাহিনী বা তাদের ইউনিটের উচ্চতর দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের শনাক্ত করব।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাহিনী বা সংস্থাগুলো তদন্তে সহযোগিতা করছে? অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কি কমিশনের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: তদন্তের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যেমন পুলিশ, র্যাব, ডিবি, সিটিটিসি—তারা মোটামুটি সহযোগিতা করছে। ডিজিএফআইয়ের সহযোগিতা কিছুটা কম। এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি হলো, গোয়েন্দা সংস্থা হওয়ার কারণে এ–সংক্রান্ত বেআইনি কাজের রেকর্ড তারা সংরক্ষণ করে না। তৎকালীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর চাওয়াতেই সেটা হয়েছিল এটা পরিষ্কার।
গুমে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে অবসরে গেছেন, আবার অনেকে কর্মরত আছেন। সমন দেওয়ার পরেও যাঁরা কমিশনে আসেননি, তাঁদের তিন–চারজন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। যাঁরা আসেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ‘অ্যাডভার্স প্রিজাম্পশন’ হবে। অর্থাৎ অভিযুক্তকে বলা হয় তার বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ আছে, সে এ বিষয়ে কিছু বলতে চায় কি না। যেমন সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ এনেছেন, তাঁদের আমরা সমন দিয়েছিলাম। তাঁদের একজন নির্দিষ্ট সময়ের পরে এসেছেন, বাকিরা আসেননি। এ অবস্থায় তাঁদের অ্যাডভার্স প্রিজাম্পশন হবে। অর্থাৎ জড়িত ছিলেন বলেই তাঁরা আসেননি। আর সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে আমরা সেনাপ্রধানের মাধ্যমে সমন দিচ্ছি। কেউ আসছেন, কেউ আসছেন না।
গুমের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীরা। এর বাইরে কত ধরনের শ্রেণি–পেশার মানুষের গুমের বিষয়ে জানা গেছে?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: কেউ গুম হওয়ার পর ‘প্রেমের টানে চলে গেছে’, ‘পাওনাদারের ভয়ে চলে গেছে’ বলে বিগত সরকারের দেওয়া এমন বক্তব্যগুলো অসত্য ও ভিত্তিহীন ছিল বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। গুম করা হতো প্রধানত চার ধরনের ব্যক্তিকে। যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মী। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বা এমন ব্যক্তি, যাঁরা বিগত সরকারের সমালোচনা করতেন। সেই সমালোচনা ফেসবুকে, বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অথবা সংবাদপত্রের কলামে, টক শোতে বা অন্য কোনো মাধ্যমে হতে পারে। যেমন গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লিখতেন।
আবার লে. কর্নেল হাসিনুর রহমানকে বলা হয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’–এর সঙ্গে কাজ করার জন্য। তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। এ জন্য চাকরিরত অবস্থায় তাঁকে গুম করা হয়। একজন চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাকে বন্দুক ঠেকিয়ে তাঁর সহকর্মীরা গুম করবে—এটা ভাবা যায়? তাঁকে দুবার গুম করা হয়। লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আলী জাহিদকেও সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় গুম করা হয়। তাঁকে ৯ মাস গুম করে রাখার পর কোর্ট মার্শাল করে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এর বাইরে জঙ্গি সন্দেহেও গুম করা হয়েছে। আমাদের কাছে গুমের ঘটনায় যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছি। ধরা যাক, জঙ্গি সন্দেহে ১০০টি গুমের ঘটনা ঘটলে তার মধ্যে ৮০টিরই জঙ্গি–সম্পৃক্ততার অভিযোগ মিথ্যা ছিল। বাকি ২০ শতাংশ সত্য হলেও হতে পারে।
আরেকটি হলো ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত বিরোধ অথবা জায়গা–জমিসহ পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে টাকাপয়সা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে গুম করা। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কারও পারিবারিক দ্বন্দ্ব হলো, তিনি র্যাবকে বা পুলিশকে গুম করতে বললেন। পরে অভিযোগ দেওয়া হলো—তুলে আনা ব্যক্তি জঙ্গি বা জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত। কখনো কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গুমের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন।
গুমের পর ভুক্তভোগী বা পরিবারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা আদায়ের ঘটনা পেয়েছেন কি না।
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: ডিজিএফআই, র্যাব, ডিবিসহ যারা গুম করত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে টাকাপয়সাও নিত। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা অথবা এ–সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার কথা বলে টাকা নিত। তবে টাকা নিয়ে তখনই মুক্ত করে দিয়েছে, এমন ঘটনা আমরা পাইনি। টাকা নেওয়ার কিছুদিন পর মুক্তি পেয়েছে, এমন ঘটনা পেয়েছি। কখনো আবার অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
কেউ গুম হওয়ার পর ‘প্রেমের টানে চলে গেছে’, ‘পাওনাদারের ভয়ে চলে গেছে’ বলে বিগত সরকারের দেওয়া এমন বক্তব্যগুলো অসত্য ও ভিত্তিহীন ছিল বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। গুম করা হতো প্রধানত চার ধরনের ব্যক্তিকে। যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মী।
এখনো নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো অপেক্ষায় আছে। নিখোঁজ ওই ব্যক্তিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন? এ ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: এ পর্যন্ত আমরা যে ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ পেয়েছি, তার মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে অন্তত ২০৪ জনের ফিরে না আসার কথা আমরা জানতে পেরেছি। আর মোট অভিযোগের মধ্যে ৪০০–৪৫০ জনের এখনো হদিস নেই।
যাঁদের হদিস নেই, তাঁদের খুঁজে পেতে আমরা কাজ করছি। তাঁদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছি। তবে ঘটনাগুলোর অনুসন্ধান করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা যা বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে, নিখোঁজ এই ব্যক্তিদের হয়তো আর পাওয়া যাবে না। যেমন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, সিলেটের ছাত্রদল নেতা দিনার, কুমিল্লার লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু—তাঁদের পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পরে ৭ আগস্ট পর্যন্ত আমরা গোপন বন্দিশালা থেকে বের হওয়ার তথ্য পেয়েছি। এরপর আর কারও বের হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
যদি ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখনো নিখোঁজ ব্যক্তিদের ঘটনাগুলোয় মামলা করে, তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে হয়তো এই বিষয়গুলো উঠে আসবে।
গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার কীভাবে নিশ্চিত হবে?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কীভাবে গুম হলো, কারা করল, দায় কাদের—চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়গুলো বলব। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তেও এই প্রতিবেদন সহায়ক হবে।
শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের নাম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি অনেকের নাম আমরা প্রকাশ করিনি। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং অপরাধীরা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন; সে জন্য আমরা সবার নাম প্রকাশ করিনি। কারণ, এঁদের অনেকের নামে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর বাইরে যাঁরা বিদেশে পলাতক, বিশেষ করে ভারতে পালিয়েছেন, ‘বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির’ আওতায় তাঁদের ফেরানোর সুযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) সংশোধন অধ্যাদেশ–২০২৪ গুমের বিচারের প্রক্রিয়া সহজ করবে। এই সংশোধনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যে রোম সংবিধি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই সংবিধির আলোকে অধ্যাদেশটি সংশোধন করা হয়েছে। সেখানকার অনেক বিধান এখানে এসেছে। এতে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে আইনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর হয়েছে। ফলে এই বিচার আন্তর্জাতিক মানের হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ভবিষ্যতে যেন জোরপূর্বক গুমের পরিবেশ তৈরি না হয়, সে জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না? কমিশন এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করবে কি না?
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: গত সাড়ে ১৫ বছরে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সেটা শেষ করে দিতে হবে। ওই সময়ে গুমগুলো করা হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। তখন সরকার, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার ট্রাস্টিজ বিচারকগণ, সার্বভৌম নির্বাহী ক্ষমতার ট্রাস্টিজ মন্ত্রীরা, সার্বভৌম আইন প্রণয়ন ক্ষমতার ট্রাস্টিজ সংসদ সদস্যরা সঠিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি। এ জন্যই আইনের শাসনের অভাব তৈরি হয়েছে। আইনের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয়নি, বেছে বেছে হয়েছিল। দেখা গেল, অপরাধী হওয়ার পরেও সরকারি দলের হওয়ায় তাঁর কিছুই হয়নি; আবার যে বিরোধী, তাঁর বিরুদ্ধে বিনা অপরাধেও মামলা হয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য। একক ব্যক্তির হাতে যেন সব ক্ষমতা না থাকে, সে জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। এ জন্য সংবিধানের পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন। পাশাপাশি সুশাসন লাগবে। আর রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে এ দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না; গুম থামবে না। রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। কেবল সৎ, নির্লোভ, চরিত্রবান, নিবেদিতপ্রাণ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরাই রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে পারেন। গুম বন্ধ হবে কি না, সেটি নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার ওপর।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মইনুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।