Image description

 দুর্বল ব্যাংককে সবল করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ঋণ সহায়তা দিয়েও তাদের তারল্য সংকট মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এখন ব্যাংকগুলো আরও তারল্য সহায়তা চাচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য কমে যাচ্ছে। আমানত সংগ্রহ বাড়ানো যাচ্ছে না। চড়া দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।

এদিকে আছে আইএমএফের চাপ। তারা খেলাপি ঋণ কমাতে, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আরও কঠোর করতে চাপ দিচ্ছে। প্রচলিত সংজ্ঞায় খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। আগামী এপ্রিল থেকে খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞা কার্যকর হবে। তখন জুন প্রান্তিকে গিয়ে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। এরমধ্যে গত সরকারের আমলে লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোতেই খেলাপি ঋণ বেশি বাড়ছে। কারণ, লুটপাট হওয়া টাকা আদায় হচ্ছে না। ওইগুলোর বড় অংশ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওইসব ঋণ এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর খেলাপি করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রায় সব সূচকে অবনতি ঘটেছে। আমানত কমেছে, তারল্য কমেছে আগের চেয়ে বেশি। গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর তারল্য কমেছে ৯৮ শতাংশ। এ অবস্থার জন্য ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব ও অনিয়মকে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রতিবেদন বলা হয়, দুর্বল ব্যাংকগুলো বর্তমানে যে তারল্য সংকট মোকাবিলা করছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে ঘটে যাওয়া কিছু অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব। সুতরাং দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা হলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়বে। তখন বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করাও সহজ হবে।  

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ব্যাংকগুলোকে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুনে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা প্রায় ২ শতাংশ। বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছে মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশ। আগে আরও বেশি হারে বাড়ত। বিনিয়োগ কমায় আমানত ও  বিনিয়োগের অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

গত জুনে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬১ কোটি টাকা। তিন মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা সাড়ে ৯৮ শতাংশ।

তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও আমদানি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে ভালো করছে। বাড়তি দামে ডলার কেনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকির আওতায় পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সবল ব্যাংকও রয়েছে।

এদিকে আর্থিক দুর্বলতার কারণে শরিয়াহভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই দুর্বল ব্যাংকের আওতায় পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয়টি অতি দুর্বল ব্যাংককে ছাপানো টাকায় সহায়তা দিয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংক চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, তারপরেও সংকট মেটাতে পারছে না।এখন ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে বেশি জোর দিয়েছে। ঋণ আদায় ছাড়া বিদ্যমান সংকট থেকে বের হওয়ার বিকল্প কোনো পথ পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণ আদায় করে পরিস্থিতির উন্নয়নও কঠিন। কারণ, ব্যাংকগুলো কিছু ঋণ আদায় করতে পেরেছে, বিশেষ করে যেসব টাকা ও উদ্যোক্তা দেশে রয়েছেন। যেসব টাকা পাচার হয়েছে বা উদ্যোক্তা পালিয়ে গেছেন ওইসব টাকা আদায় কঠিন ও সময় সাপেক্ষ।

এ ছাড়া আইন সংশোধন  করে খেলাপিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এতদিন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন আইন করতে যাচ্ছে, ব্যাংক ভালোভাবে না চালালে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধানের আওতায় সূচকের উন্নতি না হলে সেগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেবে।

এদিকে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ের ক্ষেত্রেও ভালো অভিজ্ঞতা নেই। কারণ, এর আগের সরকারের সময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা দেওয়ার ফলে গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়।এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে।

আগামী বছরের শুরু থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করতে যাচ্ছে ‘প্রমোট কারেক্ট্র অ্যাকশন প্ল্যান’। ২০০৩ সালের শেষ দিকে এ বিষয়ে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর আওতায় যেসব ব্যাংক নির্ধারিত সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এর মধ্যে ঋণ বিতরণ বন্ধ করা, আমানত সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়া উল্লে­খযোগ্য। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।